কচুরিপানা, বাংলাদেশ তো বটেই সারা পৃথিবীর অনেক জলাশয়েই এর দেখা মেলে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় এর ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে জর্জ মরগ্যান নামের এক পাট ব্যবসায়ী বাংলায় নিয়ে এসেছিলেন আমাজন এলাকার এই উদ্ভিদটি। এরপর এই উদ্ভিদের ভূত বাংলার ঘাড়ে অনেকটা চেপে বসেছিল। প্রশাসক থেকে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ থেকে গবেষক সবার মাথা ব্যথা হয়ে উঠে কচুরিপানা।
পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে অন্যতম হল কচুরিপানা। আমাদের দেশের প্রায় সব জলাশয়ে এই আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়। কচুরিপানার একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হল- উপযুক্ত পরিবেশ পেলে একটিমাত্র উদ্ভিদ মাত্র পঞ্চাশ দিনে তিন হাজারের বেশি সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে।
বাংলায় কচুরিপানার আগমন ঘটে ১৮৮৪ সালে। এ নিয়ে অবশ্য নানা তথ্য প্রচারিত রয়েছে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৮ শতকের শেষভাগে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল থেকে কচুরিপানা নিয়ে আসা হয়েছিল। মূলত আমাজন জঙ্গলের জলাশয়ে থাকা উদ্ভিদ এটি। কচুরিপানার হালকা বেগুনি রঙের অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জর্জ মরগান নামে এক স্কটিশ ব্যবসায়ী ব্রাজিল থেকে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন।
আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের একজন পাট ব্যবসায়ী অস্ট্রেলিয়া থেকে এই কচুরিপানা বাংলায় এনেছিলেন। আবার কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কচুরিপানা ব্রাজিল থেকে প্রথম বাংলায় এসেছিল ১৮৯০-এর দশকের আশেপাশে কোন সময়ে।
কচুরিপানা প্রকৃতিগতভাবে খুবই সহনশীল এবং দ্রুত বর্ধনশীল এক উদ্ভিদ। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এই একটিমাত্র উদ্ভিদ যা মাত্র ৫০ দিনে তিন হাজারের বেশি সংখ্যায় বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। এ উদ্ভিদ পানিতে ঘণ্টায় তিন মাইল গতিতে ভ্রমণ করতে পারে। বিভিন্ন প্রজাতির জলচর পাখি এদের বিস্তারে সাহায্য করে।
বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় আগমনের পর কচুরিপানা এ অঞ্চলে বহু ভোগান্তি ও যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল কচুরিপানার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার ‘ফাইটিং উইথ আ উইড: ওয়াটার হায়াসিন্থ অ্যান্ড দ্য স্টেট ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কচুরিপানাকে জার্মান পানা বলেও ডাকা হতো।
বাংলার জলাশয়ে মুক্তভাবে ভাসমান এই বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ এত দ্রুত বাড়তে থাকে যে, ১৯২০ সালের মধ্যে প্রায় প্রতিটি নদ-নদী, খাল-বিল কচুরিপানায় ছেয়ে যায়, যা সে সময় কৃষিখাতে দুর্দশা ডেকে আনে। এতে বড় ধাক্কা লাগে অর্থনীতিতে।
সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবালের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯২৬ সালের এক কৃষি প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর শুধুমাত্র কচুরিপানার কারণে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আমন ধান নষ্ট হয়। সে সময়ে পণ্য আনা-নেয়া বা বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান রুট ছিল নদী পথ। অথচ কচুরিপানার কারণে অনেক সময় জলাশয়ে চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।
আবার কচুরিপানা পচে পানির নিচে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়তো, এর ফলে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায়। এতে একদিকে পানির নিচের জলজ উদ্ভিদ মরতে শুরু করে, সেইসাথে প্রচুর মাছও মরে যায়। মানুষের জন্য এই পানি ব্যবহার করা অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল। জেলেরাও কচুরিপানার জন্য জাল ফেলতে পারতেন না।
সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল লিখেছেন, এসব কারণে তখনকার গণমাধ্যমে কচুরিপানাকে ‘বিউটিফুল ব্লু ডেভিল’ এবং ‘বেঙ্গল টেরর’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবালের গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, কচুরিপানার লাগামহীন বিস্তারে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন চেম্বার অব কমার্স ইংরেজ প্রশাসকদের কাছে নালিশ করেছিল। লিখিতপত্রে তাদের বক্তব্য ছিল যে, এ উদ্ভিদের বিস্তার ঠেকানো না গেলে রাজস্বে টান পড়বে। এরপর ইংরেজ প্রশাসকেরা অর্থনীতি বাঁচাতে কচুরিপানা নিধনের উপায় খুঁজে বের করতে গবেষকদের কাজ করার আহ্বান জানান।
সে সময় পূর্ব বাংলার কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক এবং ওয়াটার হায়াসিন্থ কমিটির সেক্রেটারি কেনেথ ম্যাকলিন ঢাকা এগ্রিকালচারাল ফার্মে, কচুরিপানার রাসায়নিক উপাদানের উপর ১৯১৬ সালে একটি গবেষণা করেন। তিনি তাতে দেখতে পান, এতে উচ্চ মাত্রার পটাশ, নাইট্রোজেন এবং ফসফরিক অ্যাসিড রয়েছে। যা উন্নত মানের জৈব সারের প্রধান উপাদান। তখন কেনেথ ম্যাকলিন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, কচুরিপানা বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার, পশু খাদ্য বা রাসায়নিক উপাদান তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রাসায়নিক সারের পরিবর্তে কচুরিপানার জৈব সার মাটির জন্য উপকারী। এই সার প্রয়োগে বেশি পরিমাণে উন্নত মানের ফসল উৎপাদন সম্ভব। কচুরিপানার এই গুণের কদর সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কারণে বিশ্ববাজারে যখন পটাশের সংকট চলছিল, তখন মেসার্স শ’ অ্যান্ড ওয়ালেস অ্যান্ড কো নামের একটি কোম্পানি ১৯১৮ সালে ভারত সরকারকে কচুরিপানা শুকিয়ে কিংবা ছাই আকারে তাদের কাছে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়।
এজন্য মন প্রতি তারা ৮৪ থেকে ১১২ রুপি পর্যন্ত দিতে রাজী হয়। তবে সেই সারে পটাশের মাত্রা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট ছিল না। পরে ভারত সরকার লম্বা ও পরিণত ভালো মানের কচুরিপানা উত্তোলনের নির্দেশ দেয়, যেখানে পটাশের পরিমাণ ভালো থাকবে। কিন্তু কচুরিপানা বেছে বেছে তোলার পরও এর বিস্তার কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিল না।
উনিশ শতকের কুড়ি এবং ত্রিশের দশকে ৪০০০ বর্গমাইল জলাশয়, বিশেষ করে ব-দ্বীপ এলাকা কচুরিপানায় ছেয়ে যায়। ‘বেঙ্গল হায়াসিন্থ বিল ১৯৩৩’ এর তথ্য অনুযায়ী কচুরিপানার কারণে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল তৎকালীন অর্থমূল্যে ৬ কোটি টাকারও বেশি। কচুরিপানা এ অঞ্চলে মহাদুর্ভিক্ষের কারণ বলেও মনে করা হয়, যার কারণে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবালের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কচুরিপানা বিস্তারের কারণে ময়মনসিংহ, খুলনার বিল এলাকা, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলসহ বিভিন্ন এলাকা, বিশেষত নিচু জমিতে, ফসল উৎপাদন করতে পারছিলেন না কৃষকেরা। বিভিন্ন এলাকা থেকে সে সময় সরকারের কাছে অভিযোগ যেত যে চাষের জমিতে কচুরিপানা উঠে আসায় ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৎকালীন প্রশাসন দ্বিধায় পড়ে যায় যে, তারা এই উদ্ভিদ নির্মূলে কাজ করবে? না এর লাভজনক ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক উপায়ের ওপর জোর দেবে?
এ নিয়ে ১৯২১ সালে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিদ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। পরের এক বছরে তারা ৭ দফা বৈঠক করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব বাংলায় কচুরিপানা মানুষের জন্য হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য তারা কচুরিপানার ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা অব্যাহত রাখা এবং এর অর্থনৈতিক ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেন। কিন্তু কচুরিপানার বিস্তার ঠেকাতে কী করা হবে সে বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। এজন্য তারা প্রাদেশিক সরকারের হাতে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবালের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরার মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ এবং ম্যালেরিয়ার প্রকোপের পেছনে কচুরিপানার পরোক্ষ ভূমিকাকে দায়ী করা হয়েছিল। সে সময় বেঙ্গলের ম্যালেরিয়া রিসার্চ ইউনিটের মাঠ পর্যায়ের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা এসএন সুর বলেছিলেন, কচুরিপানা ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী অ্যানোফিলিস মশার জন্য অনুকূল আবাস তৈরি করে। কচুরিপানা ছড়ানো জলাশয় মল দ্বারা দূষিত থাকে যা কলেরা বিস্তারের জন্য দায়ী। এছাড়া মাছ ধরতে না পারায় মানুষের পুষ্টি হুমকির মুখে পড়েছিল। কচুরিপানার কারণে জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি পশু স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়েছিল। পশুরা কচুরিপানা খাওয়ায় কারণে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতো। যার প্রভাব পড়েছিল চাষাবাদের ওপর।
এমন অবস্থায় কচুরিপানার বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিবর্তে এর নির্মূলের ধারণাটি গুরুত্ব পায়। এরপর ১৯৩৬ সালে ‘কচুরিপানা-বিধি’ জারি করে তৎকালীন সরকার। সেই বিধি অনুযায়ী, নিজ জমি বা দখলি এলাকায় কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে সবার অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জেলা প্রশাসকরা স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কচুরিপানা দমন কর্মসূচি হাতে নেন। সেসময় দেশপ্রেম ও উৎসাহ নিয়ে সাধারণ মানুষ এই কাজে যোগ দেয়। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কচুরিপানা উৎখাত শুরু হয়।
যে কচুরিপানা নিধন করতে মানুষ এক সময় মাঠে নেমেছিল, প্রায় শতবর্ষ পরে এখন তা অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এটি সার হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। আজকাল কচুরিপানা থেকে ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে বায়ো-ফার্টিলাইজার প্রস্তুত করা হচ্ছে। যেহেতু এই উদ্ভিদে প্রচুর নাইট্রোজেন উপাদান রয়েছে তাই এটি বায়োগ্যাস উৎপাদনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলোয় এই কচুরিপানা স্তূপ করে ভাসমান বেড বানিয়ে সবজি চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গবাদিপশুর খাবারে টাটকা কচুরিপানা যোগ করা হয়। এছাড়া শুকনো কচুরিপানা জ্বালানির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।
বাংলাপেডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, কচুরিপানা হাওর অঞ্চল এবং সংলগ্ন এলাকাতে ঢেউয়ের আঘাত থেকে ভিটে-মাটি রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। কচুরিপানা খুবই সহনশীল একটি উদ্ভিদ। এর পাতা আর মূলের মাঝে ফাঁপা কাণ্ডসদৃশ অংশটি দূষিত পানি থেকে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, নিকেল, সীসা এবং পারদসহ বিভিন্ন ভারী ধাতুসমূহ শোষণ করে নিতে পারে যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এরই মধ্যে প্রমাণিত। এ কারণে এরা শিল্প কারখানার বর্জ্য পদার্থ মিশ্রিত পানিকে জৈব পদ্ধতিতে দূষণ মুক্ত করতে পারে।
এই মুহূর্তে কচুরিপানা সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কুটিরশিল্পে। এর ডাটা শুকিয়ে ঝুড়ি, আসবাবপত্র, হ্যান্ডব্যাগ, দড়ি, ফুলের টব, কাগজ, মাদুরসহ নানা ধরনের গৃহস্থালী সামগ্রী তৈরি হচ্ছে, যা পরিবেশবান্ধব ও প্লাস্টিক সামগ্রীর বিকল্প হতে পারে। বাহারি এসব পণ্যের সিংহভাগ বিদেশে রফতানি হচ্ছে। অর্থাৎ এক সময়কার জলজ অভিশাপ এখন পরিণত হয়েছে জলজ সম্পদে।
আপনার মতামত জানানঃ