গত বছরের নভেম্বর মাসে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। তিন কোটি টিকার প্রথম কিস্তির ৫০ লাখ জানুয়ারি মাসেই পাওয়ার কথা ছিলো। বাকি টিকা ধাপে ধাপে পাওয়া যাবে৷ ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কোভ্যাক্সের ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশকে দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী ইতোমধ্যে সরকার ১২০ মিলিয়ন ডলারও তাদের প্রদান করেছে। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদার পুনেওয়ালা নতুন বছরের শুরুতেই ঘোষণা করে যে, তারা এই মুহূর্তে টিকা রপ্তানি করতে পারছে না। তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর মাস দুই তিন পর রপ্তানি করা হবে বলে জানানো হয়। এতে চলতি মাসে এবং প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা পাবার কথা থাকলেও সে-ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
যদিও সরকারের বিভিন্ন তরফ থেকে জানানো হয়ে আসছিল যে, সেরামের নিষেধাজ্ঞার কবলে বাংলাদেশ পড়বে না। যেহেতু বাংলাদেশের সাথে চুক্তি হয়েছে জি-টু-জি অর্থাৎ সরকার টু সরকারের সাথে। কিন্তু এই চুক্তি নিয়ে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানিয়েছেন, ‘এখানে জি টু জির (বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের সরকার) কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মানে আমার জানা নেই। আপনারা যে জি টু জির কথা বলছেন, স্বাস্থ্যসচিব বলেছেন, উনি কোন ভ্যাকসিনের কথা বলছেন, আমি জানি না। এটা হতে পারে অন্য ভ্যাকসিন।
সেরামের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে দুই ধরনের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দেশে দ্রুত অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ভারতের কাছ থেকে টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন উদ্যোগ নিয়েছে অন্য উৎস থেকেও টিকা সংগ্রহের জন্য। ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র পাশাপাশি এবার বিকল্প উৎস থেকে করোনার টিকা (ভ্যাকসিন) সংগ্রহে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেককে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়াল (পরীক্ষা) পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর।তারা শীঘ্রই টিকা উৎপাদন করে ট্রায়ালে চলে যাবে বলে জানান গ্লোব বায়োটেক।
এদিকে টিকার পরীক্ষা, গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের জন্য সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যের কাছে একটি প্রস্তাব দেয় চীনের আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি লিমিটেড। এটি দেশটির চংকিং জিফেই বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি গত ২ সেপ্টেম্বর প্রথম ট্রায়ালের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। সম্প্রতি আবারও আবেদন করেছে। তাদের আবেদনের প্রায় চারমাস পর তাতে নীতিগতভাবে সম্মতি দিয়েছে বিএসএমএমইউ।
গত সোমবার চীনের ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লিখিত এ প্রস্তাব দেয়া হয় বলে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য প্রফেসর ডা. কনককান্তি বড়ুয়া জানান, তারা চীনের ওই প্রতিষ্ঠানের টিকা তৈরির ট্রায়ালে প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। তবে এখনো তা প্রিলিমিনারি পর্যায়ে আছে। আরও কিছু তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে, তা পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
এছাড়াও রাশিয়া ও চীনে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. এসএম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানান, ‘টিকা সংগ্রহের জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আওতায় অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন) এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের সহযোগিতায় গঠিত ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি’র (কোভ্যাক্স) আওতায় আট কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮০টি দেশ গ্যাভি’তে যুক্ত হয়েছে। কোভ্যাক্স সুবিধার অধীনে প্রতিটা দেশের ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিনের নিশ্চয়তা দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
গত ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছি। সেই বিষয়গুলো তো হাতে আছেই। যেমন- চাইনিজ ভ্যাকসিন, রাশিয়ান ভ্যাকসিন, এগুলো আমাদের হাতে আছে। এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। এখনো তাদের ট্রায়াল শেষ হয়নি। তাদের ট্রায়াল শেষ হলে আমরা এগ্রিমেন্টে যাব।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এতোদিন টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সর্বস্তরেই কিছুটা ঢিলেমি ভাব ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, করোনা সংক্রমণ পর্যায়ক্রমে সহনীয় মাত্রায় নিম্নমুখী হবে। সেরাম এবং কোভাক্স সুবিধার আওতায় যে টিকা কেনা হয়েছে তা দিয়েই করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে। কিন্তু ভারত থেকে সেরামের টিকা যথাসময়ে প্রাপ্তি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় এখন অন্য উৎস থেকেও টিকা কেনায় অধিকতর জোর দেয়া হচ্ছে।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভারতের উপর নির্ভরশীল হয়ে দেশ এখনো টিকা প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা অবস্থানেই আসছে না অর্থাৎ দেশ টিকা প্রাপ্তি নিয়ে এখনো গভীর ধোঁয়াশার মাঝে আছে। কোথা থেকে টিকা সংগ্রহ করা হবে এই বিষয়েও সরকার এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৩০ টি দেশে করোনা টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো টিকা প্রাপ্তি বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারেনি। এতে দেশ ভয়াবহ করোনাক্রান্তি পেতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। একইসাথে অন্যান্য সূত্র থেকে কীভাবে টিকা পাওয়া যেতে পারে সে-বিষয়ে সরকারের এখনোই সিদ্ধান্তে এসে নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ