বাংলাদেশে বাজারব্যবস্থার প্রসঙ্গ উঠলে একইসাথে আলোচনায় আসে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি। সিন্ডিকেট বলতে একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া বা নির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলকে বোঝানো হয়। এ কাজ ভালো কিংবা খারাপ দুটোই হতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশে সিন্ডিকেট বলতে মূলত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বোঝায় এবং এই শব্দটি নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার হয় আসছে।
যেখানে এক দল ব্যবসায়ী বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে ইচ্ছামতো পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাম বাড়িয়ে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করে।
অভিযোগ আছে এরকম ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। অর্থাৎ পণ্যের উৎপাদনে কোনও ঘাটতি না থাকা এবং সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার পরও তারা গুদামজাত করে এবং সংকটের কথা বলে বেশি দামে বিক্রি করে। এতে ভোক্তার জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে কিছুদিন পর পর কোন না কোন পণ্য সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ছে। কখনও মুরগী, পেঁয়াজ, আটা, সয়াবিন তেল, কাঁচা মরিচ, ডিম এমনকি ডাব ও রোগীকে দেয়া স্যালাইনও বাদ যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে সিন্ডিকেট এখন একটি নিয়মিত এবং আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাম বাড়ানোর পেছনে কোভিড মহামারীর সময় সরবরাহ সংকট, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, ডলার সংকট নাহলে সরবরাহ সংকট এমন নানা ইস্যুকে অজুহাত হিসেবে সামনে আনা হয়।
কিন্তু ভোক্তা স্বার্থের পক্ষে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা উল্লেখ করে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অসহায়ত্ব
সরকারের একাধিক মন্ত্রী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও ক্রেতাকে সুরক্ষা দিতে তাদের কঠোর কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।
বরং তাদের বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে ধারণা করা যায় যে, এই কারসাজিতে সরকারই অসহায় হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে গত ২৬শে জুন সংসদ অধিবেশন চলাকালে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতাদের কঠোর সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন।
মন্ত্রী এমন সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন, ‘চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এটা ঠিক যে বড় বড় গ্রুপগুলো একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে।”
“আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার- আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম, সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে যে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে সেটা সইতে তো আমাদের কষ্ট হবে। এজন্য আমরা আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে চেষ্টা করি” মন্ত্রী বলেছিলেন।
কিন্তু এখন এসে সেই বক্তব্য থেকে ইউটার্ন নিয়েছেন মন্ত্রী। বুধবার এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেছেন যে, “নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট আছে এমন কথা তিনি বলেননি।
তিনি বলেছেন, “বাজারে সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেট ভাঙব— এ ধরনের কোনও কথা তো আমি বলিনি।”
এর আগে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিন্ডিকেট নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙা যাবে না, এটা কোনও কথা না।’
এ পর্যায়ে, প্রধানমন্ত্রী জানতে চান সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না কোন মন্ত্রী বলেছেন। জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা উঠে এলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরবো তো।
যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার দীর্ঘ বৈঠক হলেও তিনি তার কাছে এ বিষয়ে কিছু জানতে চাননি।
“মন্ত্রীদের ভেতরেই সিন্ডিকেট আছে”
তবে সিন্ডিকেটের বিষয়ে মুখ খুলে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়েছিলেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার।
গত ১১ই মে এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।’
‘আমরা যখন বাজারে যাই তখন দেখি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কেন ঊর্ধ্বগতি? আমাদের কিন্তু কোনও কিছুর অভাব নেই। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশের এই অবস্থা বিরাজ করছে।’ তিনি বলেন।
এর দুইদিন পর ১৩ই মে পাল্টা জবাব দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এক সমাবেশে কামাল আহমেদ মজুমদারের উদ্দেশে বলেন, ‘নিজে মন্ত্রী, সিন্ডিকেট নিজে থামান। এগুলো বললে নিজের গায়ে আসে।’
এরপর কামাল আহমেদ মজুমদার এক দৈনিক পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মন্ত্রিসভার সদস্য, আমলাদের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতরেই সিন্ডিকেট আছে। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা মন্ত্রী।’
সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট বেশি শক্তিশালী
সিন্ডিকেটের কাছে সরকারের এই জিম্মি দশা আরও বেশি হতাশায় ফেলেছে ভোক্তাদের। এ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এতো আলোচনা হলেও এই চক্র থেকে নাগরিকদের মুক্ত করতে সরকারের কার্যকর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে- সরকারের চেয়ে কি সিন্ডিকেট কি বেশি শক্তিশালী?
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাঠ-পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং প্রতিযোগিতা কমিশন।
তবে সেই অভিযান সিন্ডিকেটের ব্যাপ্তির তুলনায় খুবই নগণ্য বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।
এ ব্যাপারে খোদ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, শুধুমাত্র কয়েকটি বাজারে নজরদারি ও জেল জরিমানা করে এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামানো অসম্ভব।
কেন্দ্রীয় বিপণন ব্যবস্থার ভেতরে যে অনিয়ম ও অস্থিরতা চলছে সেটি সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করা না গেলে, শুধু অভিযানে কাজ হবে না বলে তিনি জানান।
এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের জনবল সংকট পুরনো সমস্যা হলেও এখনও এর সমাধানে কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ঢাকায় ২০০টির বেশি বাজারের জন্য রয়েছে অধিদফতরের মাত্র আটটি দল। জেলা পর্যায়ের অবস্থা আরও করুন। সেখানে মাত্র একজন কর্মকর্তা দিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার নজরদারি করছে৷
সফিকুজ্জামান বলেন, “আমাদের প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ প্রচণ্ড জনবল সংকট। আমাদের ১৭টি জেলায় কোন কর্মকর্তা নেই। সারাদেশে মাত্র ৭০ জন কাজ করেন। এই জনবল নিয়ে ১৭ কোটি ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করা অসম্ভব।
তার মতে, ব্যবসায়ীদের অসাধু তৎপরতা থেকে স্থায়ীভাবে বের করে আনতে না পারলে শুধু জেল জরিমানা করে লাভ নেই। এক্ষেত্রে বিপণন ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রয়োজন।
এসডব্লিউএসএস/২১৫০
আপনার মতামত জানানঃ