ট্রাম্পপন্থী সমর্কদের সহিংস বিক্ষোভে আমেরিকা উত্তাল। ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটাল হলে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য শহরেও। দফায় দফায় ট্রাম্পপন্থী বিক্ষোভকারীদের সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। এতে আহত ও নিহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেষ খবর পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা একজন নারী সহ চারজন, আহতে অসংখ্য।
জানা যায়, আমেরিকার আইন-প্রণেতারা নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জো বাইডেনের জয় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করার জন্য অধিবেশনে বসেছিলেন। কিন্তু তার আগেই উত্তাল হয়ে উঠল ওয়াশিংটন ডিসি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শত শত সমর্থক তখন আমেরিকার আইনসভা কংগ্রেসের ভবন ক্যাপিটালে হামলা চালান। কয়েক হাজার সমর্থক ট্রাম্পের সমর্থনে স্লোগান তুলে ক্যাপিটাল বিল্ডিংয়ে জোর করে ঢুকে পড়েন। মুহূর্তেই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় ক্যাপিটাল বিল্ডিং চত্বর। এ সময় বিক্ষোভকারীরা ক্যাপিটাল ভবনের দরজা জানালায় ভাঙচুর চালায়। কয়েক ঘণ্টা ধরে একপ্রকার ক্যাপিটাল দখল করে রাখে বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় পুলিশের। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ক্যাপিটাল বিল্ডিংয়ে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করতেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা চত্বর। এখন পর্যন্ত চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আরো কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর সামনে এসেছে। গ্রেফতার হয়েছেন পঞ্চাশেরও অধিক।
এসময় ওয়াশিংটন ডিসি’তে ক্যাপিটাল ভবনের আশেপাশে রায়ট পুলিশের টহল বাড়িয়ে দেন ওয়াশিংটনের মেয়র। দুই হাজার ৭০০ এর বেশি নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে। একইসাথে রাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে ১২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে। স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত শহরে কারফিউ জারি রয়েছে। তবুও সান্ধ্য আইন অমান্য করে সংঘর্ষ অব্যাহত রাখে বিক্ষোভকারীরা।
ওয়াশিংটনে ক্যাপিটাল হিল ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ প্রকাশ করে ট্রাম্প সমর্থকরা। এসময় দলে দলে তারা ‘আমেরিকা বাঁচাও’ স্লোগান দিতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে ট্রামপন্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের খবর আসে। বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের ধ্বস্তাধস্তির খবর পাওয়া গেলেও আহত নিহতের কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই ট্রাম্প অভিযোগ তুলে আসছেন ভোট জোচ্চুরি হয়েছে। এই ফলাফলকে তিনি কিছুতেই মানবেন না। এনিয়ে বেশ কয়েকটি স্টেটসে মামলাও করেন ট্রাম্প। সব জায়গাতেই মুখ পুড়েছে তার। কিন্তু তার পরেও একই দাবি তুলে বিভিন্ন জনসভায় প্রচার করছেন তিনি। গত বুধবার(০৬ জানু) দিনের শুরুতে হাজার হাজার ট্রাম্প সমর্থক “আমেরিকা বাচাও” নামক একটি গণজমায়েতে অংশ নিতে ওয়াশিংটনে আসে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই জনসভায় ভাষণ দিয়ে জো বাইডেনের বিজয় অনুমোদন করার বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে নির্বাচনে কারচুপির অসত্য অভিযোগ তোলেন।
এরপর ক্যাপিটাল হিলের ভেতরে নিরাপত্তা বাধা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন ট্রাম্প সমর্থকরা। এ সময় বিক্ষোভকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকদফা সংঘর্ষ হয়।
এদিকে আন্দোলনকে উস্কে দেয়ার অভিযোগে ট্রাম্পের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফেসবুক ও টুইটার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পোস্টের মাধ্যমে সহিংসতা উস্কে দেয়া হয়েছে। এমনই অভিযোগ করছে ব্যবহারকারীরা। এজন্য ট্রাম্পের টুইটার ১২ ঘণ্টা এবং ফেসবুক ২৪ ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব সমর্থকদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেয়া বক্তব্যের ভিডিও সরিয়ে নিয়েছে। ট্রাম্প তার সমর্থকদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেও তার বক্তব্যে আবারো নির্বাচনে কারচুপির অসত্য অভিযোগ তুলেছেন। ফেসবুক ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পর্কে জানিয়েছে, “আমরা সেটি সরিয়ে নিয়েছি কারণ আমাদের বিশ্বাস তা চলমান সহিংসতা স্তিমিত করার চেয়ে সহিংসতা বাড়ানোতে ভূমিকা রাখবে।”
সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাশনাল মল চত্বরে তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন যে নির্বাচনে চুরি করা হয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যখন ক্যাপিটাল ভবনের ভেতরে ও বাইরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন ট্রাম্প আবারো একটি ভিডিও প্রকাশ করেন এবং আবারো নির্বাচনে কারচুপির অসত্য অভিযোগ তোলেন।
ইউটিউব জানিয়েছে যে তারা ভিডিওটি সরিয়ে নিয়েছে কারণ সেটি ‘নির্বাচনে কারচুপি সংক্রান্ত তথ্য ছড়ানোর নীতি’ ভঙ্গ করেছে।
টুইটার শুরুতে ট্রাম্পের ভিডিও সরিয়ে না নিলেও তার অ্যাকাউন্টের টুইট, রিটুইট, লাইক ও কমেন্ট করার ক্ষমতা রহিত করে। তবে পরে তারা ভিডিওটি সরিয়ে নেয়। টুইটার জানিয়েছে, “সহিংসতার সম্ভাবনা থাকায় আমাদের সিভিক ইন্টেগ্রিটি পলিসি অনুযায়ী আমরা এঙ্গেজমেন্ট সীমিত করছি।”
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা ভবন বা ক্যাপিটাল ভবনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের হামলার পর ট্রাম্পের সঙ্গ ছাড়ছেন তার ঘনিষ্ঠরা। হামলার পর ট্রাম্পের সঙ্গ ছাড়ার তালিকায় একেবারে প্রথমেই আছেন হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি সারাহ ম্যাথিউস। তিনি বলেছেন, ‘আজ কংগ্রেস হলে যা দেখলাম, তাতে আমি ভীষণভাবে বিরক্ত। আমাদের দেশে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর প্রয়োজন।’
সারাহর আগে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ এবং ট্রাম্পের সাবেক প্রেস সচিব স্টেফানি গ্রিসহাম পদত্যাগ করেন। তবে তার পদত্যাগের সঙ্গে ক্যাপিটাল ভবনে হামলার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিশ্চিত না।
সহিংসতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ায় এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের মেয়র শহরে আরো ১৫ দিন জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা দিয়েছেন। মেয়র মুরিয়েল বাউজার বলেছেন, “অনেকেই অস্ত্রসহ এখানে এসেছেন সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নিতে। তারা অস্ত্রের পাশাপাশি রাসায়নিক, ইট এবং বোতলও নিক্ষেপ করেছেন।”
জরুরি অবস্থার ঘোষণার ফলে ওয়াশিংটন ডিসির নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য কারফিউ দেয়া, জরুরি পণ্য সরবরাহের বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারবে শহর কর্তৃপক্ষ। ২১শে জানুয়ারি দুপুর ৩টা পর্যন্ত এই ঘোষণা বলবত থাকবে।
এদিকে ট্রাম্পপন্থীদের সহিংসতার ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইলেক্টেড প্রেসিডেন্ট তথা ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেন। তিনি জানান এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি চেনেন না। বাইডেন বলেন, “যেটা দেখা যাচ্ছে আমেরিকা সেটা নয়। বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। আর এটা শেষ হওয়া প্রয়োজন। আজ যা দেখছি তার থেকে আগের আমেরিকা অনেক ভালো ছিল।”
ক্যাপিটাল বিল্ডিংয়ে হামলা চালানোর এই নজিরবিহীন ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বজুড়ে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টুইট করে বলেছেন, ‘আমেরিকা কংগ্রেসের ইতিহাসে এটা একটা লজ্জাজনক ঘটনা।’ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এই ঘটনাকে ‘হৃদয়বিদারক এবং ঘৃণ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন। ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বুধবার এক টুইট বার্তায় এ ঘটনাকে ‘গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। টুইট বার্তায় ট্রুডো আরও বলেন, সহিংসতা কখনই মানুষের ইচ্ছাকে ছাড়িয়ে নিতে সফল হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র অবশ্যই বহাল থাকবে এবং তা হবে।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩২
আপনার মতামত জানানঃ