পৃথিবীর সপ্তম মহাদেশ হয়ে উঠবে চাঁদ। এ মহাদেশের সমস্ত সম্পদে এখনো অবশ্য কোনো দেশ ভাগ বসাতে পারেনি। তবে তার চেষ্টার কমতি রাখছে না দেশগুলো।
চাঁদকে মহাদেশ হিসেবে দেখার ধারণা তৈরি হয়েছিল আরও অর্ধশতক বছর আগে, সোভিয়েত ইউনিয়নে (রাশিয়া ইউরেশিয়াকে একক মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করে)। বর্তমানে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মিশন পরিচালনা নিয়ে এ ধারণা নতুন করে হালে পানি পাচ্ছে।
এবার মহাকাশ পরাশক্তিদের লক্ষ্য চাঁদের দুর্মূল্য পানির ওপর কর্তৃত্ব নেওয়া। এজন্য একে অপরের সঙ্গে তারা ইতোমধ্যে প্রতিযোগিতাও শুরু করেছে।
রাশিয়া লুনা-২৫ নামক নতুন একটি প্রোব চাঁদে পাঠিয়েছে। প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় পর আবারও দেশটি চাঁদে কোনো যান পাঠাল। মস্কো জানিয়েছে, আগস্টের ২১ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে এ প্রোব চাঁদে অবতরণ করবে।
অন্যদিকে ভারতের চন্দ্রযান-৩ একই মাসের ২৩ বা ২৪ তারিখে চাঁদে নামবে বলে জানা গেছে। দুই দেশের মধ্যে কোনটির স্পেসক্রাফট চাঁদে প্রথম অবতরণ করবে, তা-ই এখন দেখার পালা।
রাশিয়ান স্পেস এজেন্সির প্রধান ইয়ুরি বরিসভের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, লুনা-২৫ সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চাঁদে অবতরণ করবে। ‘আমরা প্রথমে নামার প্রত্যাশা করছি,’ ইয়ুরি বলেন।
এ প্রতিযোগিতায় রাশিয়া একটি বড় সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। এটির স্পেসক্রাফট চাঁদের প্রতিকূল দক্ষিণ মেরুতে এক বছর বা তারও বেশি সময় টিকে থাকতে পারবে। লুনা-২৫ এর অবতরণস্থলের সঙ্গে আটকানো থাকবে। চাঁদের বোগাসলাভস্কি ক্রেটারের (গর্ত) উত্তরে নামার কথা রয়েছে এটির। আর এখানেই পানির সন্ধান পাওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
ইনস্টিটিউট অভ রাশিয়ান স্পেস রিসার্চ (আইকেআই)-এর মুখপাত্র ওলগা জাকুতনিয়ায়া বলেন, অবতরণস্থলের আশপাশে চন্দ্রপৃষ্ঠের ওপর যদি জমাটবদ্ধ পানির অস্তিত্ব থাকে, তাহলে লুনা-২৫-এর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিগুলো তা শনাক্ত করতে পারবে।’
তবে তিনি জানান, মেরু অঞ্চল হলেও পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের মেরু এলাকা অনেক বেশি শুকনো। নাসার অরবিটাল প্রোবোর তথ্য অনুযায়ী, চাঁদের যেসব অঞ্চলে পানির অস্তিত্ব তুলনামূলক বেশি, সেগুলো পুরো উপগ্রহে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
ভবিষ্যতে মানুষ চাঁদের এ পানি ব্যবহার করে জ্বালানির জন্য হাইড্রোজেন, শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন এবং খাওয়ার পানি তৈরি করতে পারে। কিন্তু পানির অস্তিত্ব এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে থাকায় তা চাঁদের পানিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
লুনা-২৫ সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করতে পারলে তৎক্ষনাৎ এটি গবেষণা শুরু করবে। কিন্তু সেসবের ফলাফল জানতে তিন–চার মাস লাগতে পারে বলে জানান জাকুতনিয়ায়া।
চাঁদের এক-একটি রাত পৃথিবীর প্রায় ১৪ দিনের সমান। আর এ রাতগুলোতে প্রচণ্ড হিমশীতল হওয়ায় লুনা-২৫ রাতের বেলা কাজ করতে পারবে না। ওই দুই সপ্তাহ এটিকে শীতনিদ্রায় রাখবেন রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা।
লুনা-২৫ পানির সন্ধানের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কাজও করবে। চাঁদের ধুলাবালি (ডাস্ট) স্পেসক্রাফট এবং (ভবিষ্যতের) নভোচারী উভয়ের জন্যই ক্ষতিকারক। ওলগা জাকুতনিয়ায়া জানান, এ মিশনের তথ্য ব্যবহার করে এ ধুলাবালি থেকে ক্ষতি বন্ধ করার উপায়ও খুঁজবেন রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা।
এ প্রাথমিক মিশন শেষ হলে রাশিয়া চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে আরও রোবোটিক মিশন পরিচালনা করতে চায়। এসব মিশনের উদ্দেশ্য হবে নভোচারীদের চাঁদে যাওয়ার আগে বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করা। তবে ভ্লাদিমির পুতিনের সরকার এ প্রকল্পের এখনো অনুমতি দেয়নি।
দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছার এ দৌড়কে ডেভিড ও গোলিয়াথের লড়াই হিসেবে অনায়াসে বিবেচনা করা যায়। এখানে ‘আন্ডারডগ’-এর ভূমিকায় রয়েছে ভারত।
ভারতের চন্দ্রযান-৩-এ রাশিয়ান প্রোবের চেয়ে যন্ত্রপাতির সংখ্যা কম। এটি প্রথম চান্দ্রদিনের পর সূর্য ডোবা পর্যন্ত কেবল পরীক্ষানিরীক্ষা চালাবে।
এর আগে রাশিয়া চাঁদের বুকে স্পেসক্রাফট অবতরণ করানোয় সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু ভারত ইতোমধ্যে ব্যর্থতার স্বাদ নিয়েছে। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২-এর ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদে অবতরণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।
ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো)-এর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং এবার তাদের ল্যান্ডার চাঁদের বুকে মানুষের হাঁটার গতিতে অবতরণ করার ব্যাপারে তারা আশাবাদী।
ইসরো জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ছয়টি অরবিটাল প্রোব চাঁদ নিয়ে পরীক্ষািরীক্ষা চালাচ্ছে। অন্য স্পেসক্রাফটের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে চন্দ্রযান-২ ইতোমধ্যে তিনটি ম্যানুভার সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
ভারত-রাশিয়ার পাশাপাশি চাঁদ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে জাপানও। এটির মহাকাশ সংস্থার তৈরি করা স্লিম মিশন আগামী ২৬ আগস্ট চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে এটির লক্ষ্য দক্ষিণ মেরু থেকে অনেক দূরে চাঁদের নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবতরণ করা।
তবে চাঁদে ‘সোনার সন্ধানে’ মিশন পরিচালনায় সবার ওপরে এখনো যুক্তরাষ্ট্রই। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলো আর্টেমিস ২ ও আর্টেমিস ৩ মিশনের মাধ্যমে আবারও চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে।
আর্টেমিস মিশন পরিচালনার জন্য স্পেসএক্স-এর স্টারশিপ রকেট ব্যবহার করা হবে। তবে স্টারশিপের প্রথম পরীক্ষায় মহাকাশযানটি বিস্ফোরিত হয়েছে। এ সপ্তাহের গোড়ার দিকে, কাকতালীয়ভাবে যখন রাশিয়ার লুনা-২৫ উৎক্ষেপণ করা হচ্ছিল, তখন নাসা’র প্রধান বিল নেলসন এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জানিয়েছেন, স্টারশিপের প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন ব্যর্থ হলেও আর্টেমিস মিশনের তারিখের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আর্টেমিস ২ মিশনটি ২০২৪ সালে চাঁদের দিকে রওনা দেবে। তবে এটি কেবল চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে। এ মিশনে তিনজন মার্কিনী এবং একজন কানাডিয়ান নভোচারী থাকবেন।
এরপর ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে পরবর্তী মিশনে প্রথমবারের মতো কোনো নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ নভোচারী চাঁদের বুকে পা রাখবেন। এ মিশনের লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করা।
নাসা বস নেলসন স্বীকার করেছেন, আবারও নতুন করে মহাকাশ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তবে তার মতে, এবার আমেরিকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া নয়, বরং চীন।
নেলসন চান না চীন আমেরিকার আগে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে গিয়ে পৌঁছুক। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যু্দ্ধ চলমান থাকলেও নেলসন রাশিয়ার মিশনের প্রতি শুভকামনা জানিয়েছেন।
২০২৪ সালে নাসা চাঁদে আরও কয়েকটি রোবটিক মিশনও পরিচালনা করতে চায়। আর্টেমিস মিশনের মাধ্যমে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথমবারের মতো মানুষ ক্যাম্প তৈরি করবে। এসব ক্যাম্প থেকে নভোচারীরা বিশেষভাবে তৈরি গাড়িতে চড়ে চাঁদের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করবেন।
আর্টেমিস মিশন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি মহাকাশ অভিযান প্রকল্পের সূচনা তৈরি করবে। এ দশকেই এ ধরনের বিভিন্ন যৌথ প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
এসডব্লিউএসএস/১৩৫৭
আপনার মতামত জানানঃ