সুমিত রায়
মঙ্গলবার এবং বুধবার ন্যাটো এবং তার মিত্ররা জোটের ৭৪ তম বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনের জন্য ভিলনিয়াস লিথুয়ানিয়ায় মিলিত হয়েছিল। আলোচ্যসূচির মূল বিষয় ছিল আশ্চর্যজনকভাবে ইউক্রেন, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ন্যাটো ইউক্রেনের সদস্যপদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পথ সরবরাহ করবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা। মঙ্গলবার বিকেলে ন্যাটোর যৌথ বিবৃতিতে মূলত ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, ইউক্রেন শীঘ্রই ন্যাটোতে যোগ দেবে না এবং তারা এ বিষয়ে কিছুই করতে পারবে না। সুতরাং এই আর্টিকেলে, ইউক্রেইন-ন্যাটো সম্পর্কের ইতিহাস, ন্যাটোর বিবৃতি, ইউক্রেন কেন ক্ষুব্ধ এবং পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
ইউক্রেইন-ন্যাটো সম্পর্কের ইতিহাস
ন্যাটোর প্রতি ইউক্রেনের মনোভাব প্রশাসনের উপর নির্ভর করে ওঠানামা করেছে। ইউক্রেনের রাজনীতি তুলনামূলকভাবে রাশিয়াপন্থী রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে যারা সাধারণত ইউক্রেনের পূর্বে বেশি জনপ্রিয় ছিল এবং তুলনামূলকভাবে পশ্চিমপন্থী রাষ্ট্রপতিরা সাধারণত দেশের পশ্চিমে বেশি জনপ্রিয়। ন্যাটোর প্রতি ইউক্রেনের মনোভাব দেশটিতে কোন সরকার ক্ষমতায় ছিল তার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়েছে। এই পরিবর্তন হয়েছে ইউক্রেনের পূর্ব দিকে জনপ্রিয় তুলনামূলক প্রো-রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ও পশ্চিম দিকে জনপ্রিয় প্রো-ওয়েস্টার্ন প্রেসিডেন্টের মধ্যে। ইউক্রেনের প্রথম রাষ্ট্রপতি লিওনিদ ক্রাভচুক বেশ পশ্চিমাপন্থী এবং ন্যাটোপন্থী ছিলেন। তিনি রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামোর (ওয়ারশ চুক্তির উত্তরাধিকারী) প্রচন্ড বিরোধিতা করেছিলেন এবং একবার বলেছিলেন যে ন্যাটোর সদস্যপদ ইউক্রেনের নিরাপত্তার সর্বোত্তম গ্যারান্টি দান করবে। তিনি ১৯৯১ সালে ন্যাটোর উত্তর আটলান্টিক সহযোগিতা কাউন্সিলে (North Atlantic cooperation Council) যোগদান করেন, ১৯৯৪ সালে শান্তি কর্মসূচির জন্য অংশীদারিত্ব কর্মসূচিতে (partnership for peace program) যোগ দেন এবং কয়েক মাস পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি লিওনিদ কুচমা আবার রাশিয়াপন্থী ছিলেন এবং বিশেষত ডনবাস এবং ক্রিমিয়ায় জনপ্রিয় ছিলেন। যদিও কুচমা ন্যাটোর সাথে তুলনামূলকভাবে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, ২০০৪ সালে তিনি বলেছিলেন যে ইউক্রেন আর ন্যাটো বা ইইউতে যোগ দিতে চায় না। সম্ভবত পুতিনকে খুশি রাখার জন্যই তিনি এটি বলেন। ২০০৪ সালে ইউক্রেনে একটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়। আর এরপর অরেঞ্জ রেভোল্যুশনের বিক্ষোভকারীরা দুর্নীতি এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগের কারণে পুনরায় ভোট দিতে বাধ্য করেছিল। এর মাধ্যমে কুচমার স্থলাভিষিক্ত হন ভিক্টর ইউশেঙ্কো। ইয়োশেঙ্কো তুলনামূলকভাবে পশ্চিমাপন্থী ছিলেন এবং ইউক্রেনের পশ্চিম অংশে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। ২০০৫ সালে, ইয়োশেঙ্কো ঘোষণা করেছিলেন যে ইউক্রেন ইইউ এবং ন্যাটো উভয়েই যোগ দিতে চায় এবং ২০০৮ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সদস্যপদ কর্মপরিকল্পনা বা মেম্বারশিপ একশন প্ল্যানের অনুরোধ করেছিলেন যা ন্যাটোতে সদস্য হতে চাওয়া দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তির রোড ম্যাপ হিসাবে কাজ করে বা কী কী শর্ত পূরণ করলে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে তার একটি মানদণ্ড সরবরাহ করে। যদি কোনও দেশ মেম্বারশিপ অ্যাকশন প্ল্যান পায়, তার অর্থ হবে যে দেশটি ন্যাটোতে যোগ দিতে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের আবেদনটি ন্যাটোতে বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি ইউক্রেনকে একটি মেম্বারশিপ একশন প্ল্যান দিতে আগ্রহী ছিল, তবে ফ্রান্স এবং জার্মানি ভাবছিল যে এটা হলে রাশিয়া বির্তক হবে। শেষ পর্যন্ত ন্যাটো ইউক্রেইনকে মেম্বারশিপ এখন প্ল্যান দেয়নি। তবে তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ইয়াপ ডি হুপ শেফার বলেছিলেন যে ইউক্রেন এবং জর্জিয়া শেষ পর্যন্ত সদস্য হবে। সব মিলে তারা ইউক্রেইনকে ঝুলিয়ে রাখে। ইউশেঙ্কোর জায়গায় এরপর রুশপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি দেশটির পূর্বদিকে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ইউক্রেনকে ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং ২০১৩ সালের শেষের দিকে রাশিয়ার কাছ থেকে উদার ঋণের পাবার জন্য তিনি ইইউর অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি ত্যাগ করার আকস্মিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন। আর এভাবেই মেইডেন বিপ্লব (Maiden Revolution) শুরু হয়। এরপর ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে অবৈধভাবে দখল করে ও ডানবাসে যুদ্ধ পরিস্থিতি শুরু হয়। এই কনটেক্সটে ইউক্রেইনে ২০১৪ সালের অক্টোবরে সংসদীয় নির্বাচন হয়, আর তাতে পেট্রো পোরোশেঙ্কোর নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ন্যাটোতে যোগদানকে অগ্রাধিকার দেয়। এই সময় ন্যাটো ইউক্রেন সম্পর্ক কিছুটা জটিল হয়ে ওঠে। প্রথমে পোরোশেঙ্কো এবং পরে জেলেনস্কির অধীনে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে আগ্রহী হলেও ন্যাটো রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত একটি দেশকে ন্যাটোতে ঢুকতে দিতে চায়নি।
ইউক্রেন ন্যাটো সম্পর্ক তখন থেকে এক ধরনের চক্রে আটকে আছে। যখনই রাশিয়া ইউক্রেনকে হুমকি দেয়, ন্যাটো প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেনকে ঢুকতে দেয় না, কিন্তু ন্যাটো সদস্যরা ইউক্রেনের জন্য মিলিটারি সাপোর্ট বাড়ায় এবং রাশিয়া এর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চক্রটি পুনরায় শুরু করে। ২০১০-এর দশকে ন্যাটো প্রথম ইউক্রেনের প্রতি তার সাপোর্ট প্রদান করে এই অভিপ্রায়ে যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ২০২০ সালের মধ্যে ন্যাটোর সাথে ইন্টারঅপারেবল হবে। এদিকে পুতিন একে ইউক্রেনে ন্যাটো সম্প্রসারণ হিসাবে যা দেখেছিলেন, আর আংশিকভাবে তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে রাশিয়া ২০২১ সালের গোড়ার দিকে ইউক্রেনের সীমান্তে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে। ন্যাটোর ২০২১ সালের বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটো আবারও বলেছে যে তারা ইউক্রেনকে মেম্বারশিপ একশন প্ল্যান সরবরাহ করবে না, তবে তারা ইউক্রেইনের সামরিক সহায়তা বাড়িয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করার পর ন্যাটো আবারও বলেছে যে, স্পষ্টতই তারা এমন একটি দেশকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনা, যারা রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এর বদলে ন্যাটো ব্যাপকভাবে ইউক্রেইনে মিলিটারি সাপোর্ট বৃদ্ধি করে। যাইহোক, যুদ্ধের এক বছরেরও বেশি সময় পরে ন্যাটো দেশগুলি ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তাহিসাবে ৬৫ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করেছে এবং পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি অনুসারে, ইউক্রেনে ন্যাটোর প্রায় ১০০ জন কর্মী কাজ করছে। ন্যাটোর কয়েকটি দেশ বিশেষত ফ্রান্স যুক্তি দেখাচ্ছে যে এই লুপটি শেষ করার এবং অবশেষে ইউক্রেনকে একটি মেম্বারশিপ একশন প্ল্যান সরবরাহ করার সময় এসেছে।
এই সম্মেলনের আগে ন্যাটো সদস্যদের অবস্থান কী ছিল?
একটু ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে শুরু করা যাক। ন্যাটোর কোনও সদস্য ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইউক্রেনকে ব্লকে আনতে চায় না। কারণ যুদ্ধের সময় যদি ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে এর অর্থ এই হবে যে পুরো ন্যাটোকেই রাশিয়ার সাথে লড়াই করতে হবে। আর এর ফলে সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটবে। কিন্তু ফ্রান্স, পোল্যান্ড এবং বাল্টিক দেশগুলি শীর্ষ সম্মেলনের আগে যুক্তি দিয়েছিল যে, ন্যাটোর উচিত ইউক্রেনকে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং মানদণ্ড সরবরাহ করা যেগুলো পূরণ করলে ইউক্রেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ এই ক্রাইটেরিয়া হতে পারে রাশিয়ার সাথে একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানো বা সশস্ত্র বাহিনীতে দুর্নীতি নির্মূল করা। আর ইউক্রেন এই কাজগুলো করতে পারে তাহলে দেশটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ন্যাটোর সদস্য হয়ে যাবে। ন্যাটোর এই সদস্যরা যুক্তি দেখান যে, এই স্বয়ংক্রিয় সদস্যপদের প্রতিশ্রুতি ইউক্রেনের জন্য ন্যায্য। কারণ ইউক্রেন ইউরোপীয় মহাদেশকে রক্ষা করার জন্য অনেক কিছু করছে, এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তি পুতিনকে তার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরতও রাখবে।
তবে ন্যাটোর অন্যান্য সদস্য, বিশেষ করে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নেন যে, ইউক্রেনের এভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ন্যাটোতে অন্তভুক্তির সম্ভাবনা আসলে পুতিনকে প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করতে পারে। ফলে এর পরিবর্তে এরা চেয়েছিল- ন্যাটো এটাই বলুক যে, ইউক্রেন কোনও সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড পূরণ না করেই ভবিষ্যতের কোন সময়ে ন্যাটোর সদস্য হবে। এই অবস্থানটির সুবিধা হচ্ছে, এটি ন্যাটোকে ভবিষ্যতে আরও নমনীয়তা দান করছে এবং কমপক্ষে আমেরিকার দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যাটোকে চীন এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও মনোনিবেশ করার সুযোগ দেয়। এই সদস্যরা আরও যুক্তি দেন যে, ন্যাটো ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত না করেই একে রক্ষা করতে পারে। যেমনটি ন্যাটো দেশটিকে সামরিক সহায়তা এবং বহুপাক্ষিক নিরাপত্তা গ্যারান্টির মাধ্যমে যুদ্ধের সময় করেছে, ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ এর মতো ন্যাটোর সদস্যরা নিজেরা যুদ্ধ না করলেও।
সিদ্ধান্ত বা বিবৃতি কী ছিল?
যাই হোক, শীর্ষ সম্মেলনে যাওয়ার আগে ন্যাটোর কিছু সদস্যের মধ্যে তখনও আশা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার বিকেলে ন্যাটো যে যৌথ বিবৃতিটি দিল তা বিচার করে মনে হচ্ছে, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিই বিজয়ী হয়েছে, কারণ এটি ন্যাটোতে ইউক্রেইনের সদস্যপদের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট পথ সরবরাহ করে না এবং ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির জন্য কোনও মানদণ্ডেরও উল্লেখ নেই। ব্যবহৃত ভাষাটি আসলে বেশ অদ্ভুত কারণ ন্যাটো পুনরায় বলেছে যে ইউক্রেনের ভবিষ্যত ন্যাটোতেই রয়েছে এবং ইউক্রেনের যোগদানের জন্য কোন পূর্ণ সদস্যপদ কর্মপরিকল্পনা বা ফুল মেম্বারশিপ একশন প্ল্যানের প্রয়োজন হবে না। বিবৃতির ১১শ ধারায় কেবল মাত্র বলা হয়েছে যে, ন্যাটো “ইউক্রেনকে জোটে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানোর অবস্থানে থাকবে যখন মিত্ররা সম্মত হবে এবং শর্তগুলি পূরণ হবে।” আর এটাই ন্যাটোতে ইউক্রেইনের অন্তর্ভুক্তিকে ঝুলিয়ে দেয়।
একদিক দিয়ে ন্যাটোর এই বিবৃতি নিয়ে খুব বেশি বিস্মিত হবারও কিছু ছিলোনা, কারণ প্রথমত, ন্যাটোতে বেশিভাগ সময় সেদিকেই চলে যেদিকে আমেরিকা চলতে বলে, আর দ্বিতীয়ত, ন্যাটো যেহেতু সর্বসম্মতির নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, মানে কোন একজন সদস্য দ্বিমত হলে তাতে ভেটো দিতে পারে, তাই ন্যাটোর বিবৃতি বা সিদ্ধান্ত সবই রক্ষণশীল হয়, মানে ন্যাটো কখনই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে যাবে না।” তবুও, জেলেনস্কির বিবৃতিটিকে ভাল লাগার কথা না। মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় তিনি এই বিবৃতিকে অযৌক্তিক বলে বর্ণনা করেন এবং দাবি করেন যে ন্যাটো তাদের বক্তব্য থেকে সরে আসার আগে ভিন্ন কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এরপর বুধবার তিনি বলেন, ন্যাটোর প্রতি এখনও তার বিশ্বাস (faith) আছে, কিন্তু কনফিডেন্স নেই।
সিদ্ধান্ত বা বিবৃতিটি ঠিক না ভুল?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জেলেনস্কির প্রতিক্রিয়া কি ন্যায্য? অন্য কথায়, এই বিবৃতিটি কি আসলেই ভুল? এই প্রশ্নগুলোর কোনও সহজ উত্তর নেই। ন্যাটোর এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেয়া যায় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পক্ষে), এর ফলে পুতিনের থেকে উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি হ্রাস হবে, এবং সেই সাথে এটাও বলে যে, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের জন্য কোন মেম্বারশিপ এখন প্ল্যানের প্রয়োজন হবে না যা ন্যাটোতে ইউক্রেইনের অন্তর্ভুক্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে সহজ করে তুলবে, এবং পাশাপাশি একটি নতুন ন্যাটো-ইউক্রেন কাউন্সিলের গঠন ন্যাটো-ইউক্রেন সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিয়ে আসবে। তারা এ বিষয়টিও উল্লেখ করবে যে, ন্যাটো এবং ন্যাটোর স্বতন্ত্র সদস্যরা এখনও ইউক্রেনে প্রচুর পরিমাণে সামরিক সহায়তা প্রেরণের মাধ্যমে তাদের কাজ করে যাচ্ছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে ইউক্রেনের সাথে ইসরায়েল-স্টাইলের সম্পর্কের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে বলে জানা গেছে। বাস্তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউক্রেনকে ন্যাটোর বাইরে রাখা হবে, তবে ইউক্রেইনের সাথে একটি দ্বিপাক্ষিক জোট তৈরি করা হবে ও রাশিয়াকে পুনরায় আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখার জন্য দেশটিকে পর্যাপ্ত সামরিক সহায়তা সরবরাহ করা হবে।
এদিকে ন্যাটোর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়া যায় (বাল্টিক দেশগুলো, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষে), এর ফলে ২০০৮ সালের মতো একই ভুল হবার ঝুঁকি থাকছে। ২০০৮ সালে বুখারেস্টে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনকে মেম্বারশিপ একশন প্ল্যান দেয়া হবে কিনা (যা পূরণ করলে ইউক্রেইন ন্যাটোর সদস্য হতে পারে) তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ইউক্রেন এবং জর্জিয়ার জন্য মেম্বারশিপ একশন প্ল্যান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন ফ্রান্স এবং জার্মানি উদ্বিগ্ন ছিল যে এর ফলে রাশিয়াকে উস্কানি দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত, ন্যাটো যে সিদ্ধান্ত নেয় তা অনুসারে, তারা ইউক্রেন বা জর্জিয়াকে কোন মেম্বারশিপ একশন প্ল্যান দেয়নি, তবে বলেছে যে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে। কিন্তু এতে উল্টে খারাপ হয়। একদিকে এই বিবৃতি পুতিনকে ক্ষিপ্ত করে, আর তিনি ন্যাটোর এক্সপ্যানশনের বিরুদ্ধে আরও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন, অন্যদিকে ইউক্রেইনের হাতেও নিজেকে রক্ষা করার জন্য আর তেমন উপায় থাকেনা। এখন ২০০৮ এর বুখারেস্ট ডিক্লারেশনের চেয়ে এবারেরটা একটু ভিন্ন কারণ এখানে তাও যুদ্ধের পর ইউক্রেইনের ন্যাটোতে যুক্ত হবার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু তবুও এই বিষয়েও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়না। আর যদি সেটা না হয় তবে ন্যাটোর জন্য খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ইউক্রেইনকে প্রচুর অর্থ সহায়তা দিতে হবে, এর আর্মিকে অনেক সহায়তা দিতে হবে, যা অনেক ব্যয়বহুল হবে। হয়, এই খরচের দিকটা ন্যাটোর এই সিদ্ধান্তটির বা বিবৃতিটির বিরুদ্ধে একটি ভাল পয়েন্ট।
২০০৮ সালের মতো এই শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত রাশিয়াকে বিরক্ত করার জন্য যথেষ্ট হলেও পুতিনকে তার আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। এর ফলে রাশিয়া ভবিষ্যতেও ইউক্রেইনে আক্রমণ করবে। আর এই অবস্থায় ইউক্রেনের সাথে ইসরায়েলের মতো সম্পর্ক রাখাটা ন্যাটো সদস্যপদের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়বহুল। এর কারণ ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়াটা সস্তা বা কম খরচে, কারণ আলাদা আলাদা সদস্য রাষ্ট্রগুলি জানে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো ন্যাটো ব্লক তার প্রতিরোধ বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করছে ততক্ষণ তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের প্রতিরক্ষায় অত অর্থ ব্যয় করতে হবে না। অন্যদিকে ইসরায়েল-স্টাইলের সম্পর্ক অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইসরায়েলে অস্ত্র প্রেরণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এখন আমেরিকা একইভাবে ইউক্রেইনের জন্যেও বিলিয়ন বিলিয়ন দলের খরচ করতে সক্ষম হতেই পারে, ইউরোপের অন্যান্য ন্যাটো সদস্যরা ইতিমধ্যেই তাদের সামরিক বাজেট যতটা সম্ভব বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছে ও ন্যাটোর কথা মতো তা সেই ডিফেন্স বাজেট বাড়াতে গিয়ে ভুগছে, সেই সাথে রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধে ইউক্রেইনকে সাহাজ্য করতে গিয়ে তাদের অস্ত্রের মজুদও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ন্যাটোর ইউরোপীয় দেশগুলো যেখানে এসব নিয়েই উদ্বিগ্ন সেখানে ইউক্রেইনের সাথে ইজরায়েল-স্টাইলের সম্পর্কের ব্যয়ের বোঝা তাদের জন্য অনেক ভারী হয়ে যাবে। আর এই ব্যাপারটা যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসের মন্তব্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন তিনি বলেন, ন্যাটো সদস্যরা ইতিমধ্যে ইউক্রেনে অস্ত্র প্রেরণের জন্য তাদের রিজার্ভ মজুদগুলি খালি করছে, “আর তাই ইউক্রেনকে (ক্ষিপ্ত না হয়ে) ন্যাটোর প্রতি আরও কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত।”
শেষ পর্যন্ত, ইতিহাস ২০২৩ সালের এই ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনকে সফল বা ব্যর্থ বলে বিচার করে কিনা তা নির্ভর করবে পরবর্তীতে কী ঘটবে তার উপর। রাশিয়া যদি এই যুদ্ধে ভাল করতে শুরু করে বা যুদ্ধে এডভ্যান্টেজ লাভ করে, তাহলে ন্যাটোর এই সিদ্ধান্তকে ব্যর্থ ধরা যাবে, আর সেই সাথে পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও বাল্টিক দেশগুলো “আমি তো আগেই বলেছিলাম” বলার সুযোগ পেয়ে যাবে। অন্যদিকে যদি ইউক্রেন যুদ্ধে আরো ভাল করতে শুরু করে, আরও লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত রাশিয়াকে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেইনে তাদের অধিকৃত অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য করে, তবে ন্যাটোর এই সিদ্ধান্ত সফল বলে বিবেচিত হবে, আর আমেরিকা এবং জার্মানি তাদের বিচক্ষণতার জন্য প্রশংসা কুড়োবে।
আপনার মতামত জানানঃ