মার্কিন অর্থনীতিবিদ ব্রাড সেটসারের মতে, চীন ছয় ট্রিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার বিজার্ভ ‘মজুত’ করেছে, যার অর্ধেকই ‘লুকানো’। আর এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য চায়না প্রজেক্ট-এ এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও ট্রেজারি বিভাগের সাবেক এই কর্মকর্তা লেখেন, দেশটির প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পিপলস ব্যাংক অভ চায়নার অফিসিয়াল নথিতে দেখানো হয় না। তার পরিবর্তে, এসব ‘ছায়া রিজার্ভ’ চীনের রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ঋণদাতা এবং পলিসি ব্যাংক অভ চায়নার মতো প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়।
ব্রাড সেটসার লেখেন, চীনের অফিসিয়াল রিজার্ভ যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাড়েনি, তবে রপ্তানি উদ্বৃত্তের পাশাপাশি ‘লুকোনো রিজার্ভ’ আরও বেড়ে চলেছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, রিজার্ভের ক্ষেত্রে চীনের স্বচ্ছতার অভাব বিশ্বের জন্য কিছুটা সমস্যার। দেশটি বৈশ্বিক অর্থনীতির এতটাই কেন্দ্রে যে, চীন যা কিছু করে — প্রকাশ্যে হোক বা লুকিয়ে — শেষ পর্যন্ত তা বিশ্বের বাকি অংশে একটি বিশাল প্রভাব ফেলে।
‘লুকোনো’ রিজার্ভ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে চীনের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অভ ফরেইন এক্সচেঞ্জ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বাইডেন প্রশাসনের সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা সেটসার লেখেন, চীনের রিজার্ভের প্রভাবের একটি উদাহরণ হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন — যে প্রকল্প অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কার পর দখলদারিত্ব বাড়াতে গ্রহণ করা হয়েছে।
সেটসারের মতে, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্ভবত ছয় ট্রিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সম্পদ আছে। কিন্তু গত বছরের শেষে অফিসিয়াল রিজার্ভ দেখানো হয়েছিল ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে নিউ ইয়র্কভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস-এর সিনিয়র ফেলো সেটসার আরও লেখেন, চীনের অভ্যন্তরীণ ঋণ সমস্যা নিয়ে আলোচনার মধ্যে এই ‘লুকোনো রিজার্ভ’-এর পরিমাণ স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশটি এখনো বিশ্বব্যাপী বড় ঋণদাতা এবং তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রভাব এখনো বিশ্বজুড়ে অনুভূত হয়।
এদিকে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১ হাজার ১৩৬ টন সোনা মজুত করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৫০ টন বেশি। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা মজুতের এই পরিমাণ গত ৫৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ বাজারবিশ্লেষক লুইস স্ট্রিট রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে বলেন, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের সম্পদ হিসেবে বেশি পরিমাণ সোনা মজুতের ওপর জোর দিচ্ছে। এ কারণে সোনা কেনার পরিমাণও বেড়েছে। গত বছর ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ সোনা কিনেছে, তা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে রয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনেও অনেক ওঠানামা হচ্ছে। শিগগিরই এই পরিস্থিতি বদলাবে বলেও কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এমন এক অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে সোনার কদর অনেক বেড়েছে।
চীন ছাড়ছে ধনীরা
অক্টোবরের শেষ নাগাদ দেখা যায়, প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪০০টি প্রাক-মালিকানাধীন ফ্ল্যাট বিক্রির বিবেচনায় রাখা হয়েছে। যা তার আগের মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। স্থানীয় আবাসন প্রশাসন ব্যুরোর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফ্যাঙদি ডটকম চায়না এ তথ্য দিয়েছে।
স্থানীয় সম্পত্তি মধ্যস্থতাকারীদের সাধারণ তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা ২০২১ সালের শেষের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
পুডং নিউ এরিয়ার প্রপার্টি এজেন্সি ফাইভআইফাইভজের সিনিয়র ম্যানেজার সং ইউলিন বলেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক ধনী ব্যক্তি তাদের প্রপার্টি সম্পত্তি বিক্রি করে মুক্ত হতে চাচ্ছেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছেন, স্থানীয় আবাসন বাজারের মন্দা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, এসব মানুষের বেশিরভাগই হয় অভিবাসনের কথা ভাবছে বা বিদেশে তাদের সম্পদের কিছু অংশ স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে।
বিক্রয়ের জন্য রাখা অতিরিক্ত সেকেন্ড-হ্যান্ড বাড়িগুলো শহরের সম্পত্তি বাজারে শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ার অনুভূতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অভূতপূর্ব তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর একটি বড় নীতিগত পরিবর্তন হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ধনীদের অর্থে ভাগ বসানো হবে, যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
সাংহাইয়ের ৪৮ বছর বয়সী বাসিন্দা এডি ঝু বলেছেন, তিনি তার ১০ মিলিয়ন ইউয়ান ( ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার) মূল্যমানের বাড়ি ফেলে পর্তুগালে যাবেন। কারণ তার পরিবার সে দেশে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, একটি মন্দা প্রবণতা (বাড়ির দামে) আকার ধারণ করছে এবং বাজারের আরও মন্দা এড়াতে আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চুক্তি বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সাংহাই ও চীনের আরও মধ্যবিত্ত আগামী বছরগুলোতে দেশ ছেড়ে যাবে। কারণ অর্থনীতির সম্ভাবনা নিয়ে তাদের ক্রমে উদ্বেগ বাড়ছে।
অক্টোবরে শি’কে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করা হয়। এর ফলে তার ‘কমন প্রসপারিটি বা সাধারণ সমৃদ্ধি’ নীতি বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করা হলো, যার লক্ষ্য সম্পদের ব্যবধান কমানো এবং ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণ রোধ করা।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে অন্য একজন বাড়ির মালিক বলেছেন, বেইজিং শিগগিরই একটি সম্পত্তি কর আরোপ করতে পারে, যার ফলে তার পরিবারকে বছরে হাজার হাজার ইউয়ান খরচ হতে পারে। তিনি আরও বলেন, একাধিক ফ্ল্যাট আছে এমন অনেক বাড়ির মালিক কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অন্তত একটি বিক্রি করবেন।
ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সের তথ্যমতে, সাংহাইতে প্রাক-মালিকানাধীন বাড়ির দাম গত মাসের তুলনায় অক্টোবরে দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে প্রথমবারের মতো শহরের সম্পত্তির দাম মাসে মাসে কমেছে।
স্থানীয় মধ্যস্থতাকারীরা বলছেন, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে মালিকদের তাদের চাওয়া দাম ১০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে, সাংহাইয়ের কেন্দ্রস্থলে একটি দুই বেডরুমের বাড়ির প্রতি বর্গ মিটারে প্রায় এক লাখ ইউয়ান মূল্য ট্যাগ রয়েছে।
সাংহাই শহরের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও পেশাদারদের প্রবাহের কারণে ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিক থেকে বাড়ির দাম বেড়েছে। ১ জুন থেকে দুই মাসের লকডাউনে মূল ভূখণ্ডের বাণিজ্যিক ও আর্থিক কেন্দ্র নিমজ্জিত হওয়ার পরও শহরের বাজার স্থিতিশীল ছিল।
সাংহাইয়ের প্রপার্টি এজেন্সি বাওনুওর মালিক ইউ লিয়াংজুর মতে, অথচ সেপ্টেম্বর থেকে বাড়িওয়ালাদের ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ছাড় দিতে হয়েছে।
সাংহাইতে ভাড়াও কমছে। কিছু বাড়িওয়ালাদের ২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিতে হচ্ছে। কারণ শূন্য করোনা নীতির কারণে চীনের বাণিজ্যিক কেন্দ্রের প্রবাসী বাসিন্দা ও উচ্চ আয়ের বেতনভোগীরা এই এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।
সিবিআরই চায়নার গবেষণা দলের প্রধান স্যাম জি বলেন, শূন্য-করোনা নীতি শিথিল করলেই কেবল শহরের পতনশীল আবাসন এবং বাড়ি ভাড়ার বাজারের মন্দা পরিস্থিতি মধ্য অবস্থায় রাখা যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বিদেশি কোম্পানির নির্বাহী ও ব্যবসায়ীরা অবশেষে ফিরে আসবেন। সেকেন্ড-হ্যান্ড বাড়ি কেনার আগ্রহ এবং বাড়ি ভাড়ার চাহিদা ততক্ষণে পুনরুদ্ধার হবে।’
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ