
কাজী ফয়সাল : বাংলাদেশের একজন লেখক সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, “কী পশ্চিম বাংলা, কী বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।“ সেই লেখক আর কেউ নন, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
বাংলা সাহিত্যে যেসকল লেখক তাদের লেখাতে গভীর জীবনবোধ, বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাত এবং রাজনৈতিক ইতিহাস পরিস্ফুট করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মধ্যে প্রথম দিকটা দখল করে আছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত নামটি হল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। পেশাগতভাবে ছিলেন শিক্ষক, লিখেছেন খুব স্বল্প সংখ্যক উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি। কিন্তু লেখার শক্তিতে এখনও পাঠকের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ৪ জানুয়ারী, ২০২১; প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী।
লেখক আখতারুজ্জামান ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে পৈত্রিক বাড়ি ছিল বগুড়া জেলায়। বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তার মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস।
আখতারুজ্জামান বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন।
আখতারুজ্জামান জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনের শুরু করেন। এরপর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্যও ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার চাপ থাকলেও তিনি অগণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়ায় যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকেন। নিজের যৌক্তিকতা, বুদ্ধিমত্তা এবং আদর্শের সাথে আপোষ করেননি কখনো।
ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তি যোদ্ধাদের আশ্রয় দেন এবং গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তার বিভিন্ন লেখায় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ উঠে এসেছে। যেমন ‘প্রতিশোধ, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর, ‘খোঁয়ারি, ‘মিলির হাতে স্টেনগান, ‘অপঘাত, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, ‘রেইনকোট’প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার কাহিনী। দেশভাগের কর্কশ স্মৃতি এবং হিন্দু মুসলিমের সংকট দ্বারাও তার লেখা প্রভাবিত হয়েছিলো।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখতেন খুব কম। উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র দুটি, গল্পের সংখ্যা সবমিলিয়ে ২৭/২৮টি। তবে তার লেখার সাহিত্যমান তাকে বাংলা সাহিত্যে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সংখ্যায় নয়, গুণগত বিচারে তিনি প্রায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। উপন্যাস রচনায় সমকালে তাঁর সমতুল্য একজন লেখককেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাস্তবতার চিত্রায়ন, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তার রচনাকে করেছে অন্যদের থেকে আলাদা। তবে লিখেছেন প্রবন্ধ এবং কবিতাও। ইলিয়াসের আছে একটি প্রবন্ধ সংকলন আর কিছু কবিতা। গল্প রচনাতেও তৈরি করেছেন নিজস্ব একটা শৈলী। ইলিয়াসের কাজ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘ইলিয়াসের উপন্যাস প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বমানের, নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন যেসব কথাসাহিত্যিক, তিনি ছিলেন সেই মাপের লেখক।“ ইলিয়াসের কিছু কাজ অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু চলচ্চিত্র।
তার রচিত “চিলেকোঠার সেপাই” ও “খোয়াবনামা” উপন্যাস দুটি বাংলা সাহিত্যে এপিক। বয়ান ভঙ্গি, চরিত্রচিত্রণ, সমকালকে জীবন্ত করে তোলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার উপন্যাস দুটি বাংলা সাহিত্যে অন্য সব উপন্যাস থেকে আলাদা সাহিত্যরসের সন্ধান দিয়েছে।
ইলিয়াস নিজের সাহিত্যে কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৭ সালে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কার, সাদাত আলী আখন্দ পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক ও ১৯৯৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদক অর্জন করেছেন।
১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ক্যান্সারে ভুগতে থাকা আখতারুজ্জামানের জীবনকালের সমাপ্তি ঘটে।
স্বল্পায়ু আখতারুজ্জামান প্রয়াণের পরের শতাব্দীতে নিজের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছেন তার লেখনীর শক্তি দিয়ে।
আপনার মতামত জানানঃ