নীল জলরাশির মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল হিমশৈল। কোথাও আবার সমগ্র সমুদ্রের উপরিতলই ঢেকে গেছে বরফের চাদরে। উত্তর আটলান্টিক এবং সুমেরু মহাসাগরে গেলেই দেখা যাবে এমন দৃশ্যের। এমনকি আজ থেকে একশো বছর আগে আটলান্টিকে ভাসমান এমন একটি হিমশৈলের সঙ্গে সংঘাতেই ডুবতে হয়েছিল ঐতিহাসিক জাহাজ আরএমএস টাইটানিককে। কিন্তু উত্তর গোলার্ধের এই দুই অন্যতম মহাসাগর থেকে যদি উধাও হয়ে যায় সমস্ত বরফ? তাও মাত্র ৬-৭ বছরের মধ্যেই?
চমকে উঠছেন নিশ্চয়ই? তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে এমনটাই। গত মঙ্গলবার বিজ্ঞানপত্রিকা ‘নেচার কমিউনিকেশন জার্নাল’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যেই গ্রীষ্মকালে সম্পূর্ণ বরফহীন হয়ে পড়বে সুমেরু মহাসাগর।
ধারণার থেকেও দ্রুত গলছে উত্তর মেরুর বরফ। বিজ্ঞানীরা এখন আশঙ্কা করছেন যে, ২০৩০-এর দশকেই উত্তর মেরু বরফহীন হয়ে যাবে। নতুন এক গবেষণা প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, আমরা এতদিন ভবিষ্যৎ জলবায়ু সংকটের যে প্রভাবের আশঙ্কায় ছিলাম, তা এখন বাস্তব হওয়ার একদম কাছাকাছি রয়েছে। এ খবর দিয়েছে সিএনএন।
খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার ন্যাচার জার্নালে ওই গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয় যে, ২০৪০ সালের আগেই এমন অবস্থা দাঁড়াবে যে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আর্কটিক সাগরে কোনো বরফ থাকবে না। এমনকি এখন থেকেই যদি দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করে দেয়, তাহলেও এই পরিণতি ঠেকানো যাবে না। ২০৫০ সালের মধ্যেই পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে আর্কটিক সাগর বরফ শূন্য থাকবে।
১৯৭৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তত্ত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া তারা স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্যও ব্যবহার করেছেন। এতে তারা দেখেছেন যে, আগের মডেলগুলোতে বরফ গলার হারকে কম করে দেখানো হয়েছিল। বরফ গলার পেছনে মানব সৃষ্ট কারণগুলিকে কম দায়ী করা হয়েছিল সেসব মডেলে।
গবেষণার প্রধান লেখক ও পোহাং ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক সেউং-কি মিন বলেন, আমরা বিস্মিত হয়েছি যে, আমাদের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের এত এত চেষ্টার পরেও আমাদেরকে এখন গ্রীষ্মকালে একটি বরফ-মুক্ত আর্কটিক সাগর দেখতে হবে।
আর্কটিক বরফ শীতকালে তৈরি হয় এবং তারপর গ্রীষ্মে গলে যায়। সাধারণত চক্রটি আবার শুরু হওয়ার আগে সেপ্টেম্বরে তার সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছায়। তবে দিন যত যাচ্ছে এই অবস্থা বদলাচ্ছে। প্রথম দিকে শুধু সেপ্টেম্বর মাসই বরফমুক্ত থাকবে। তবে আস্তে আস্তে তা গোটা গ্রীষ্মকালের জন্যই সাধারণ অবস্থায় পরিণত হবে। এমনকি দূর ভবিষ্যতে শীতকালেও বরফ কম দেখা যাবে আর্কটিকে।
তবে আর্কটিকে বরফগলন কোনো নতুন বিষয় নয়। যুগ যুগ ধরে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে গলে যায় আর্কটিকের বরফের চাদরের একটা বড়ো অংশ। আবার শীতকালে তুষারপাত ঢেকে দেয় সেই ক্ষতদাগকে। তবে সেই সমীকরণ বিঘ্নিত হয়েছে বিগত কয়েক দশকে। ১৯৭৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সংগৃহীত উপগ্রহ চিত্র এবং জলবায়ু মডেলের বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, গরমকালে যে-পরিমাণ বরফ গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল থেকে, তার এক-তৃতীয়াংশও পুনরুদ্ধার করতে পারছে না শীতকালীন তুষারপাত। আর সেই কারণেই প্রতিবছর সংকুচিত হচ্ছে আর্কটিকের বরফের চাদর।
এই হিসেব মেনেই, ২০৩০ সালের কাছাকাছি গ্রীষ্মকালে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ বরফহীন হয়ে পড়বে সুমেরু মহাসাগর। যদিও সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে না বরফের অস্তিত্ব। শীতকালে তুষারপাতের সময় খানিক বরফ দেখার সৌভাগ্য হবে আঞ্চলিক মানুষদের। তবে সেটাও ২০৫০-এর দশক পর্যন্তই। তারপর সুমেরু মহাসাগরের চেহারা হবে ভারত কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের মতো।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৮০ সালের পরপরই পুরোপুরি বরফহীন হয়ে যাবে আর্কটিক সাগর। যদি এই হারে জ্বালানি তেল পুড়ানো হয় এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী অন্যান্য কার্ক্রম অব্যাহত থাকে তাহলে এই পরিণতি ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই। উল্টো, সামনের দিনগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে উত্তর মেরু হয়ত ধারণারও পূর্বে বরফহীন হয়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ