বিয়ে, গায়ে হলুদ, সুন্নতে খৎনা ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে গান বাজনা করা যাবে না মর্মে নতুন আইন ঘোষণা করলো নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার বন্দর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য, পঞ্চায়েত এবং মসজিদ কমিটি। একই সাথে এই আইন অমান্য করলে শাস্তি স্বরুপ তাদের বিয়ে পড়াতে ইমাম সাহেব অংশগ্রহণ করবেন না, এমনকি অই পরিবারে কেউ মারা গেলে তার জানাজায় মসজিদের ইমাম সহ অন্য কেউ অংশগ্রহণও করবেন না। গত শুক্রবার(০১জানু) জুমার নামাজের সময় স্থানীয় পঞ্চায়েত ও মসজিদ কমিটির সদস্যরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা যায়। এবং নতুন এই আইন ও অমান্যে শাস্তির বিষয়টি অত্র এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাইকিং করা হয়।
এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার সাব্বির আহম্মেদ ইমন। শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ডের স্থানীয় পঞ্চায়েত ও মসজিদ কমিটির লোকজন বাগে জান্নাত জামে মসজিদে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছ বলে জানিয়েছেন তিনি। এই সিদ্ধান্তে তিনি নিজে একমত আছেন এবং তার নির্দেশেই অত্র এলাকায় মাইকিং করে হুঁশিয়ারি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য, পঞ্চায়েত এবং মসজিদ কমিটির যৌথ নির্দেশে ঘোষণায় বলা হয়, ইসলাম ধর্মাবলম্বী কোনো পরিবার এই নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের বিয়ে পড়াতে বা দোয়ায় কোনো আলেম অংশগ্রহণ করবে না। এমনকি অই পরিবারের কেউ মারা গেলে তার জানাজায় মসজিদের কোনো ইমাম বা অন্যকেউ অংশগ্রহণ করবে না বলে হুঁশিয়ারি করে দেওয়া হয়।
বন্দর ইউপি সদস্য সাব্বির আহম্মেদ ইমন গণমাধ্যমকে জানান, ‘বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাগে জান্নাত জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান জুমার নামাজের খুতবার আগে বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে গান-বাজনার প্রসঙ্গটি তোলেন। পরে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং মাইকিং করা হয় এলাকায়। এই নির্দেশ কোনো পরিবার অমান্য করলে, তাদের পরিবারের কেউ মারা গেলে তার জানাজা পড়াতে কিংবা ওই পরিবারের কোনো সদস্যের বিয়েতে কোনো ইমাম বা আলেম যাবেন না। সিদ্ধান্তের এই বিষয়টি সঠিক।’
আওয়ামী লীগের কর্মী বলে পরিচয় দেওয়া এই ইউপি সদস্য আরো বলেন, উচ্চ স্বরে গান-বাজনায় মানুষের ক্ষতি হয়। বারবার বলার পরও তা কেউ মানছে না। এ জন্য এবার এই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ঘরের ভেতর টিভিতে কিংবা মোবাইলে গান শুনলে কোনো সমস্যা নেই। লাউড স্পিকারে গান বাজানো যাবে না। আমি একা না, এতে স্থানীয় পঞ্চায়েত এবং মসজিদ কমিটির সমর্থন আছে।
বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ রশীদ বলেন, এমনটা কেউ করতে পারেন না। আমি এ বিষয়ে খোঁজ নেব। আগামীকাল (আজ রবিবার) পরিষদে গিয়ে এই বিষয়ে তদন্ত করা হবে। তারপর ওই ইউপি সদস্যকে ডেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন, উচ্চ স্বরে কেউ গান বাজিয়ে অন্যকে বিরক্ত করলে সেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই জানাজা ও বিয়ে না পড়ানোর বিষয়টি বাড়াবাড়ি।
বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুক্লা সরকার বলেন, এমনটা তারা করতে পারেন না। এই বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে। বিশেষ করে ইউপি মেম্বারকে ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এদিকে গান-বাজনা করলে বিয়েতে ও জানাজায় মসজিদের ইমামের অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশিত হলে তা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেকে বিষয়টিকে বাড়াবাড়ি বলছে। অনেকেই ফেসবুক পোস্টে বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে এমন কোনো আইন নেই, স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক কোনো নির্দেশনাও নেই যে অনুষ্ঠানে গান বাজনা করলে তাদের বিয়েতে ইমাম যাবে না, জানাজায় ইমামসহ স্থানীয়রা অংশগ্রহণ করতে পারবে না। বরং এটা স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও পঞ্চায়েতের লোকজনের দেশের আইনবিরোধী আইন, তাদের অতিসত্বর আইনের আওতায় আনার জোর দাবিও জানান তারা। যারা এই নতুন আইন ঘোষণা করলো তাদের প্রত্যেকের আয় উপার্জন শরিয়ত মোতাবেক হচ্ছে কিনা সেই বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন।
এদিকে নতুন এই আইন নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলেও দেখা দিয়েছে বিরুপ প্রতিক্রিয়া। তারা বলেন, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য মৌলবাদীদের এ এক নিদর্শন। নিজেরা ধর্ম-কর্মের চৌহদ্দির বাইরে থাকলেও অন্যকে জোর করে সীমানার ভেতরে রাখার এই জঙ্গিপনা আফগানিস্তান পাকিস্তানে খাটলেও বাংলাদেশে খাটবে না। কারণ বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র যেখানে দেশের নিজস্ব আইন আছে, সংবিধান আছে। মৌলবাদীদের এইসব গোপন চক্রান্ত সরকারের প্রশয়ে দিন দিন বাড়ছে বলে অভিযোগ তোলেন অনেকে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এটা হেফাজতেরই এক গোপন চক্রান্ত। কদিন আগে হেফাজতের ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন এবং দেশকে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার যে পায়তারা তারই একটি অংশ বিশেষ নারায়নগঞ্জের এই ইউনিয়ন।
এসময়ের তরুণ কবি শঙ্খচূড় ইমাম বলেন, বিয়ে সাদীতে গানের রেওয়াজটা আমাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। সেই আদিকাল থেকে বিয়েতে চাচি খালা ফুফু ভাবীরা দলবেঁধে গীত না খাইলে বিয়ে পরিপূর্ণ হতো না। এখন হয়তো সেই আঞ্চলিক গীত নেই, তবে সেটার অবস্থান দখলে নিয়েছে আধুনিক সংগীত। বিয়েতে আনন্দ উৎসবটাই আসল, সেটা এখনকার গানের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আনন্দ উৎসবকে কেন্দ্র করেই তো উপমহাদেশে সুন্নতে খৎনা সহ অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিয়ে খৎনাতে গানের বিরোধীতা করার অর্থ হলো আনন্দ উৎসবটাকে মাটি করে দেওয়া। আর আনন্দ উৎসবটা না থাকলে বিয়ে সাদীটাও পরিপূর্ণ হয়ে উঠে না বলে মনে করেন এই তরুণ কবি। তিনি বলেন, যদিও সুন্নতে খৎনা বিয়ে সাদীর মতো অনুষ্ঠানগুলো ধর্মীয় রীতি অনুসারেই হয়ে থাকে, সেখানে আনন্দ উৎসবের অংশ হিসেবে গানের ব্যাপারটিও ওৎপ্রোতভাবে লেগে আছে।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএই/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ