গত সোমবার রাতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক গ্যাস লিক হওয়ার ঘটনায় যেকোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সোমবার ঢাকার খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী, বেইলি রোড, তেজগাঁও, মহাখালী, লালবাগ, ইস্কাটন, বাড্ডা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, হাজারীবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের ঝাঁঝাল গন্ধ পেলে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তিতাস কর্তৃপক্ষ বলেছে, ঈদের ছুটিতে গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে চাপ বেড়ে যায়। যার ফলে বিভিন্ন লিকেজ দিয়ে গ্যাস বের হতে থাকে। পরে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেওয়া হলে রাতের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাই আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু আসলেই কি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই!
তিতাস গ্যাস লাইনে অসংখ্য লিকেজ রয়েছে। এসব লিকেজ নিয়ে নিয়মিত গ্যাস বের হচ্ছে। ঈদের ছুটিতে গ্যাসের চাপ বাড়ায় বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের গন্ধ পেয়েছেন খোদ সাধারণ মানুষ। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে নগরজুড়ে। বিভিন্ন এলাকার মসজিদে মাইকিংও করা হয়েছিল। বন্ধ ছিল রান্নার চুলা। তিতাস কর্তৃপক্ষও লিকেজের বিষয়টি স্বীকার করেছে।
তারা জানায়, শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় লাইনে ওভার ফ্লো বা চাপ বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। তাদের বক্তব্যেই গ্যাস লিকেজের বিষয়টি প্রমাণিত বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গ্যাসের লাইনের লিকেজের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে নগরবাসী।
লিকেজগুলো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এলেই অগ্নিকা- ঘটতে পারে। সেখান থেকে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া বদ্ধ কোথাও এই গ্যাস জমা হলে সেখান থেকে বিস্ফোরণের ঝুঁকিও থেকে যায়। এতে মানুষের জীবনও হুমকির মুখে রয়েছে।
ভয়াবহ ঝুঁকিতে সাধারণ মানুষ
তিতাসের গ্যাস লাইনে অসংখ্য লিক রয়েছে তা প্রমাণিত বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন। এসব লিকের কারণে রাজধানী ঢাকা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। মানবজমিনকে বলেন, আমাদের স্বাভাবিক সময়ও লিক দিয়ে গ্যাস বের হয়। তখন এত অল্প গ্যাস বের হয় যেটা আমরা বুঝতে পারি না।
কিন্তু এখন যেহেতু প্রেসার বেশি সেহেতু এই লিকগুলো থেকে বেশি গ্যাস বের হচ্ছে। তাই এগুলো মানুষের নাকে আসছে। এই লাইনে এসব লিকেজ থাকার কথা না। এই গ্যাসগুলো ধীরে ধীরে বের হয়ে কোনো জায়গায় একত্র হলে সেখানে কোনো আগুনের সংস্পর্শ পেলে বিস্ফোরণ হতে পারে। এটাই ভয়ের বিষয়। আমাদের একটা সিটিগেট স্টেশন আছে। এই জায়গায় যদি আগে খেয়াল করতো এখানে কতটুকু চাপ আছে তাহলে এটা কমিয়ে দিলে নিয়ন্ত্রণে আসতো।
কোনো জায়গায় ৫ শতাংশ গ্যাস একত্রিত হলে সেখানে কোনো স্পার্ক বা আগুন পায় তাহলে বিস্ফোরণ হতে পারে বলে জানান এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। ইজাজ হোসেন বলেন, ঢাকা শহরে যে বিস্ফোরণগুলো হচ্ছে তাতে বোঝা যায় বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস জমা হচ্ছে। এখানে সাংঘাতিক ঝুঁকি রয়েছে। আমরা নাকে গ্যাস পেয়েছি। কিন্তু সেখানে হয়তো তা একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। স্বাভাবিক সময়েও যদি সুযোগ পায় ধীরে ধীরে একত্রিত হয়ে বিস্ফোরণ হতেও পারে। এই ঘটনায় আমরা প্রমাণ পেলাম তিতাস লাইনে শত শত লিক আছে। কিছু কিছু লিক আছে বড়।
গ্যাস লাইনের পুরো সিস্টেমে প্রচুর লিকেজ হচ্ছে। যেখানে লিকেজ হচ্ছে সেখানে ম্যাচ, সিগারেট ফেললে আগুন লেগে যেতে পারে। সেই আগুন থেকে আরও বড় আগুন লাগার শঙ্কাও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম। মানবজমিনকে তিনি বলেন, বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমেই মূলত বিস্ফোরণ হয়। খোলা জায়গায় আগুন লাগতে পারে। সেই আগুন থেকে বড় আগুন লাগতে পারে।
তবে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা কম। সিস্টেমে প্রেসার বেড়ে যাওয়ার কারণে যেসব জায়গায় লিক জয়েন্ট আছে, স্ক্রু, বাল্ব বা রিং লাগানো আছে এসবের প্রেসার ক্যাপাসিটি আছে। এগুলো দুর্বল অবস্থায় আছে। তাই স্বাভাবিক সময়ে প্রেসার কম থাকলে লিকেজ কম হয়। গ্যাস সরবরাহ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় নাই যেজন্য প্রেসার বেড়ে গিয়ে লিকেজ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
গ্যাসের লাইনে লিকেজের ব্যাপারটি বহু আগেই উন্মোচিত হয়েছে। হাজার হাজার লিক রয়ে গেছে নেটওয়ার্কে। এই লিকেজ মেরামত করা হয় না। লাইনের তদারকি, পরীক্ষা করা হয় না বলে জানিয়েছেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি মানবজমিনকে বলেন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে কয়েক হাজার লিকেজের কথা বলা আছে। ঢাকায় নিয়মিত গ্যাস লিকেজ হয়ে বাতাসে ছড়াচ্ছে। এবার গ্যাসের চাপ বেশি থাকায় সেটা বাতাস ভায়োলেট করতে পারেনি। তাই মানুষ ঘ্রাণেই বুঝতে পেরেছে তারা গ্যাসের মধ্যে বাস করছে। অটোমেটিক গ্যাস কন্ট্রোলের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হওয়ার কথা কিন্তু সেই ক্ষমতা তাদের নাই। এটা ভয়ঙ্কর দিক।
এ ছাড়া তাদের পাইপলাইনে ছিদ্র আছেই। ছিদ্রযুক্ত পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ করা, সেই গ্যাস লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়া এবং মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ানোর মতো অপরাধ করা হচ্ছে। এসব কারণে সবার আগে বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। তারা স্বীকারও করেছে এটা হচ্ছে। এটা স্বীকারোক্তিমূলক অপরাধ।
তিনি বলেন, জীবনের জন্য বিপন্নকর ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হতে পারে। এজন্য কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ও চাকরিচ্যুৎ সবই হতে পারে এই অবহেলায় দায়ে। কিন্তু দেশের শাসন বিভাগের তরফ থেকে যে পদক্ষেপ নেয়া হবে সেখানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যদি এই কোম্পানির বোর্ডে থাকে এবং তারা প্রশ্রয় দেয় তাহলে আমাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার মাত্রা আরও বাড়ে।
যেখানে গ্যাসের লিকেজ বা গন্ধ পাওয়া যাবে সেখানে দাহ্য বস্তুতে যেমন থাকবে আগুন লাগার সম্ভাবনা ততই বেশি থাকবে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যে এলাকায় এমন ঘটনা ঘটবে সেই এলাকার বাসিন্দাদের গ্যাসের হটলাইন নাম্বারে গ্যাসের গন্ধের বিষয়টি জানাতে হবে। গ্যাসের গন্ধ পাওয়া জায়গার আশপাশে দাহ্য বস্তু সরিয়ে ফেলতে হবে। যদি আগুন ধরেও যায় তাও কোনো বড় ধরনের সমস্যা না হয়। ওই জায়গায় বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। বদ্ধ রাখা যাবে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ