দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে আসছিলেন যে, প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সমুদ্রের গভীরতায় প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব। কারণ বেশি গভীরতায় পানির চাপ অনেক বেশি, তাপমাত্রাও শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু এ ধারণাটি ১৯৭৭ সালে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। বিস্তারিত জানিয়েছে বিবিসি।
গত সপ্তাহে বিজ্ঞানীরা মহাসাগরের আট কিলোমিটার গভীর থেকে একটি মাছের ভিডিও ধারণ করেছেন, যা ফুটেজ তোলা মাছ হিসেবে সবচেয়ে গভীরতম মাছের নতুন রেকর্ড গড়েছে।
জাপানের দক্ষিণ-পূর্বে ইজু-ওগাসাওয়ারা ট্রেঞ্চে ৮,৩৩৬ মিটার গভীরতায় সিউডোলিপারিস প্রজাতির স্নেইলফিশের সাঁতার কাটার ভিডিও একটি গবেষণার কাজে ব্যবহৃত রোবটের ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করা হয়েছে।
এর আগের রেকর্ডটি ছিল জাপান এবং পাপুয়া নিউগিনির মধ্যবর্তী মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ৮,১৭৮ মিটার গভীরে, যেটির নাম দেওয়া হয় মারিয়ানা স্নেইলফিশ (সিউডোলিপারিস সুইরেই)।
সমুদ্রের গভীরতম অংশ ‘হেডাল জোন’ নামে পরিচিত, যার নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক পাতালপুরীর দেবতা হেডিসের নামে। সমুদ্রের ছয় থেকে ১১ কিলোমিটার অংশের এই হেডাল জোন এক নিষিদ্ধ জায়গা। সমুদ্রের এই অংশ সম্পূর্ণ অন্ধকার তো বটেই, সাথে তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি এবং পানির চাপও অকল্পনীয়।
দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করে আসছিলেন যে, এই প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সমুদ্রের গভীরতায় প্রাণীর বেঁচে থাকা অসম্ভব। কিন্তু এই ধারণাটি ১৯৭৭ সালে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়, যখন একটি মার্কিন গবেষণা দল একটি রোবট যানকে প্রশান্ত মহাসাগরের আট হাজার ফুট গভীরতার এক হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের কাছাকাছি পাঠাতে সক্ষম হন। হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলোতে ম্যাগমা সমুদ্রের পানির সাথে মিলিত হয়।
১৯৭৭ সাল থেকে সমুদ্রবিজ্ঞানীরা এই ভেন্টের আশপাশ থেকে ৬০০টি নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন, যা এর আগে অন্য কোথাও দেখা যায়নি। এর মধ্যে রয়েছে একটি আঁশযুক্ত গ্যাস্ট্রোপড, শক্ত বর্মযুক্ত শামুক এবং ‘দ্য হফ’ নামের একটি নতুন কাঁকড়া।
এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রচণ্ড চাপ, শীতল তাপমাত্রা এবং হেডাল অঞ্চলের অন্ধকার অবস্থায় কীভাবে প্রাণিকুল টিকে থাকে তা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশেপাশে থাকা প্রাণীদের নিয়ে গবেষণা করা ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক অ্যাবি চ্যাপম্যানের মতে, “মারিয়ানা ট্রেঞ্চের নিচে চাপের পরিমাণ ১,০৮৬ বার, যা আপনার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা ১০০টি হাতির সমতুল্য।”
হেডাল অঞ্চলে বসবাস করা সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর এই চরম পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য কোষীয় স্তরে অভিযোজিত হতে হয়েছে।
দৈত্যাকার অ্যামফিপড ক্রাস্টেসিয়ান এবং মারিয়ানা শামুক মাছের মতো প্রাণীগুলোতে পাইজোলাইটস নামক জৈব অণুর উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে, যা তাদের কোষের প্রাচীর এবং প্রোটিনগুলোকে অত্যন্ত উচ্চ চাপে ভেঙে যাওয়া থেকে বাধা দেয়।
এই অণুগুলো জীবের কোষের ভিতরে প্রোটিনগুলোর বাইরে সুরক্ষা স্তর হিসেবে কাজ করে, যা পানির ওজনকে প্রতিহত করে। ম্যাসাচুসেটসের উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের ডিপ-সি জীববিজ্ঞানী টিম শ্যাঙ্কের মতে, “এটা অনেকটা তাঁবুর মতো কাজ করে। বাইরে থাকা পানির চাপ থেকে ভেতরের জিনিসগুলোকে রক্ষা করে।”
গবেষণা থেকে দেখা যায়, যে প্রাণী সমুদ্রের যত গভীরে বাস করে, তাদের শরীরে পাইজোলাইট অণুর পরিমাণ তত বেশি।
২০২২ সালে লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের করা এক গবেষণা থেকে জানা যায়, এই জৈবিক অণুগুলো পানির অণুর সাথে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বন্ধন তৈরি করে ‘পানির মধ্যে একটি অ্যাঙ্কর পয়েন্ট’ এর মতো কাজ করে। এর ফলে প্রাণীটি পানির প্রচণ্ড চাপ প্রতিরোধ করতে পারে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি অর্থাৎ একেবারেই কম গভীরতায় থাকা মাছগুলোর শরীরে ‘সুইম ব্লাডার’ নামের একটি অঙ্গ থাকে। এই গ্যাসভর্তি অঙ্গটি তাদেরকে গভীরে চলে যেতে বাধা দেয় আবার পৃষ্ঠে যেন ভেসে না ওঠে, সে ব্যাপারেও সাহায্য করে। স্নেইল ফিশের মতো গভীর সমুদ্রের মাছে এই সুইম ব্লাডার থাকে না, কারণ গ্যাসভর্তি অঙ্গ পানির প্রচণ্ড চাপে বাইরের দিকে চলে আসতে চাইবে, যা তাদের শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে।
গভীর সমুদ্রে সরাসরি সূর্যালোক না পৌঁছাতে পারায় প্রাণীগুলো সূর্যের শক্তিকে শর্করায় রূপান্তর করতে পারে না। এর পরিবর্তে তারা সমুদ্রের তলদেশে থাকা হাইড্রোথার্মাল ভেন্টের আশেপাশে ঘটা রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে নির্গত শক্তি ব্যবহার করে শর্করা তৈরি করতে কেমোসিন্থেসিস প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। শ্যাঙ্ক জানান, “তারা সমুদ্রের তলদেশ থেকে বেরিয়ে আসা রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে টিকে থাকে।”
গভীর সমুদ্রের মাছও কম অক্সিজেন পরিবেশে বেঁচে থাকার মতো করে বিবর্তিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের একটি গবেষণা থেকে দেখা যায় পৃষ্ঠের মাছের তুলনায় গভীর সমুদ্রের মাছগুলোর লোহিত রক্তকণিকার আকার অনেক বড় থাকে, যা হিমোগ্লোবিনের উচ্চ ঘনত্ব তৈরি করে। মেক্সিকান কেভ ফিশ এরকমই একটি উদাহরণ।
এই সমস্ত অভিযোজন প্রাণীদের গভীর সমুদ্রের অন্ধকার অতল গহ্বরে, আমাদের গ্রহের সবচেয়ে কঠোর পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। সূত্র: টিবিএস।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ