সে কোটি কোটি বছর আগের কথা। মঙ্গলগ্রহ ছিল আর্দ্র আর উষ্ণ একটি গ্রহ। ঘন বায়ুমণ্ডল এটাকে রক্ষা করত। দীর্ঘ নদী বয়ে যেত কুলুকুলু ধ্বনিতে। জলে ভরা লেক আর সাগর ছিল। বিজ্ঞানীরা ব্যাপক গবেষণায় জানতে পেরেছেন এসব তথ্য। কিন্তু এই সম্পদ হারাল কোথায়?
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের ঠিক কী হয়েছিল, তা এখন জানতে পেরেছেন বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গবেষকেরা।
ম্যাভেন নামের একটি মহাকাশযানের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে গতকাল বৃহস্পতিবার মঙ্গলগ্রহ সংক্রান্ত বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন, যার মধ্যে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের কী হয়েছিল, সে তথ্যও রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, তারা এখন জানেন যে এখনকার মঙ্গলগ্রহ আর সেই মঙ্গলগ্রহ এক নয়। এখন শুষ্ক আর শীতল এক গ্রহ এটি। যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীদের কাছে মঙ্গলগ্রহের এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার রহস্য ঘিরে ছিল।
এ রহস্যের সমাধান প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নাসার প্রধান কার্যালয়ে এক ঘোষণায় মার্স এক্সপ্লোরেশন প্রোগ্রামের প্রধান বিজ্ঞানী মাইকেল মেয়ার শিল্পী বব ডিলানকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘বন্ধুরা, এর উত্তর হচ্ছে, ঝড়ো হাওয়ায় সব উড়ে গেছে।’
আজ থেকে ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম হয় মঙ্গলগ্রহের। তখন তার চৌম্বকক্ষেত্র শক্তিশালী ছিল, ফলে সহজেই সৌরঝড় প্রতিহত করা যেত। কিন্তু ক্রমশ চৌম্বকক্ষেত্র দুর্বল হয়ে আসার ফলে সেই ক্ষমতা কমে যায়। আর সৌরঝড়ের প্রভাবেই ‘উড়ে গিয়েছে’ মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল। আজ সেখানে সামান্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাই প্রাণধারণের কথা কল্পনাই করা যায় না।
নাসার গবেষকেরা বলেন, মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডল ও উদ্বায়ী বিবর্তন সাক্ষ্য দেয় সৌরঝড়ে কবলে পড়েছিল মঙ্গলগ্রহ। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলের সূর্য থেকে সৌরঝড়ে ধেয়ে আসা চার্জযুক্ত কণা মঙ্গলের অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো গ্যাস শুষে নিয়ে গেছে।
মঙ্গলের সম্ভাব্য জীবনধারণের উপযোগী উপাদানগুলোও সৌরঝড়ে মিলিয়ে গেছে। এর অর্থ, আদি পর্যায়ে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছিল।
তাত্ত্বিক দিক হিসেবে ধরলে মঙ্গলের মতো পৃথিবীকেও একই অবস্থা বরণ করতে হতে পারে। কারণ পৃথিবী থেকেও আয়ন হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নাসার গবেষকেরা সম্মেলনে বলেছেন, আমাদের অত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমাদের গ্রহ এখন ঠিক আছে কারণ, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে।
ম্যাভেন নভোযানের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মঙ্গলগ্রহের মেরুপ্রভা আর পৃথিবীর সুমেরু প্রভা প্রায় একই রকম। যখন সৌরঝড় থেকে আসা চার্জিত কণা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং মেরুর দিকে পরিভ্রমণ করে বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় কণার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় তখন মেরুপ্রভা তৈরি হয়।
কিন্তু মঙ্গলগ্রহে যেটুকু চৌম্বকক্ষেত্র অবশিষ্ট আছে সেখান থেকেই এর মেরুপ্রভার উৎপত্তি হয়। অর্থাৎ, মঙ্গলের মেরুপ্রভা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এ ছাড়া মঙ্গলগ্রহের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে এর ধুলা। এর উৎপত্তি হচ্ছে অন্য কোথাও, অন্য কোনো গ্রহে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠে যে ধরনের ধূলিকণা বা বালি দেখা যায়, তা মঙ্গলের চাঁদ ফোবোস বা ডেমোস থেকে আসতে পারে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছায় ম্যাভেন। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণার জন্য এই নভোযানটি সেখানে পাঠানো হয়ছে। এ গবেষণার ফলে মঙ্গলগ্রহ আমাদের বাসযোগ্য হবে কি না, তা বোঝার দারপ্রান্তে চলে এসেছি আমরা।
বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্বের সঙ্গে চৌম্বকক্ষেত্রের অস্তিত্ব অত্যন্ত নিবিড়। চৌম্বকক্ষেত্র দুর্বল হলে বায়ুমণ্ডল অস্তিত্ব হারায়। আর তখন প্রাণধারণও অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই গবেষণার সূত্র ধরেই মোটামুটি ধারণা করা সম্ভব, পৃথিবীতে আর কতদিন প্রাণধারণের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় থাকবে।
তাছাড়া নাসা, স্পেস-এক্স সহ নানা সংস্থা যে মহাকাশে প্রাণধারণের উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজছে, সেখানেও নতুন মাপকাঠি যোগ করা সম্ভব। হয়তো এভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে নতুন কোনো গ্রহ। আর পৃথিবী ছেড়ে সেখানেই গড়ে উঠবে মানুষের উপনিবেশ।
এসডব্লিউএসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ