যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বজোড়া একচ্ছত্র খবরদারি এবং মার্কিন ডলারের একচেটিয়া প্রভাব এখন হুমকির মুখে। আর এর কারণ—ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ; সম্প্রতি মস্কোতে অনুষ্ঠিত ভ্লাদিমির পুতিন ও সি চিন পিংয়ের বৈঠক এবং ইরান ও সৌদি আরবকে এক টেবিলে বসানোর বিষয়ে চীনের দৃশ্যমান সাফল্য।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গড়ে তোলা সংগঠন ব্রিকস-এর ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন করে সম্প্রতি প্রকাশিত আমার বৈশ্বিক নীতিবিষয়ক একটি প্রতিনেদন এই দিকেই বিশ্ব অর্থনীতির ঝোঁক দৃষ্টিগোচর করেছে।
ব্রিকস নামক গ্রুপটি বর্তমানে ইরান ও সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছে। বিষয়টি ব্রিকসের সদস্যপদ দেওয়ার প্রক্রিয়া এবং সংগঠনটির নিজস্ব ব্যাংক ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর ভূমিকা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলতে পারে। তবে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, অধিকতর বড় ও ব্যাপকতর প্রভাবশালী ব্রিকস-প্লাস সত্যিই কি ডলারকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে কি না।
বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থায় ডলারের ভূমিকা হুমকি মুখে পড়া নতুন কিছু না। এটি অবশ্যম্ভাবী যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দিন পড়ে যায়, তাহলে ডলার অবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাউন্ড স্টার্লিং-এর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য ছিল (যদিও পাউন্ড তার বিশ্বব্যাপী প্রভাব থেকে একেবারে ছিটকে যায়নি)।
ডলারের উজ্জ্বলতা ফিকে হয়ে যাওয়াটা এক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খারাপ কিছু হবে না। কারণ, বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা ইস্যু করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যে দায়দায়িত্ব নিতে হয় তার অনেকটাই এর ফলে লাঘব হবে।
পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো প্রভাব ধরে রাখতে পারছে না, সেখানে আমেরিকান মুদ্রাব্যবস্থা ও ফেডারেল রিজার্ভের অভ্যন্তরীণভাবে চালিত অগ্রাধিকারের ওপর অন্য সবার খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে থাকাটা ভালো হবে না। এ অবস্থায় অন্যান্য দেশ তাদের নিজেদের মুদ্রা ও নিজেদের আর্থিক নীতিকেই বেশি পছন্দ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা অতিরিক্ত প্রভাবিত নয় এমন দেশগুলোকেই বাণিজ্য অংশীদার করার বিষয়ে তারা বেশি আগ্রহী হবে।
কিন্তু ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে উদীয়মান শক্তিগুলো একজোট হয়ে যে অতি উচ্চ আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখাচ্ছে, তা এখনো যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির জন্য কোনো হুমকি নয়। বিশেষ করে ব্রিকস এবং সম্ভাব্য ব্রিকস-প্লাসভুক্ত দেশগুলো নিজেরাই হাজার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে হাঁপাচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত তারা শুধু প্রতীকী যৌথ বিবৃতি দেওয়ার বাইরে আসলে কী অর্জন করতে পেরেছে, তা স্পষ্ট করতে পারেনি।
এ গ্রুপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির দেশ হলো ভারত ও চীন। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে এতটাই সাপে-নেউলে সম্পর্ক যে তাদের মধ্যে যেকোনো বিষয়ে সহযোগিতামূলক আচরণ একেবারেই দুর্লভ ঘটনা। যতক্ষণ না এই দুই দেশের মধ্যে বৈরী ভাব না কাটছে, ততক্ষণ ব্রিকস তো দূরের কথা, আরও দেশ অন্তর্ভুক্ত করে গড়ে তোলা ব্রিকস-প্লাসের পক্ষেও ডলারের সামনে কোনো গুরুতর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা সম্ভব হবে না।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশ ভারত ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার অভাব আমাকে প্রায়ই হতাশ করে। যদি এই দেশ দুটি তাদের ঐতিহাসিক শত্রুতা কাটিয়ে উঠতে পারে; বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করার মতো একটি উচ্চাভিলাষী অ্যাজেন্ডা তৈরি করতে পারে; স্বাস্থ্যহুমকি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারে, তাহলে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ব্রিকস-চালিত চ্যালেঞ্জের ধারণাটি শুধু প্রশংসনীয় নয় বরং অনিবার্য হয়ে উঠবে।
আর এ জন্য চীনকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) মহাপ্রকল্পের ডিজাইন প্রণয়নে সহযোগিতা করতে ভারতকে আগবাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে বিআরআইয়ের উচ্চাভিলাষী অ্যাজেন্ডা উপলব্ধি করা এশিয়াকে অনেক বেশি শক্তিশালী করবে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিআরআই ইস্যুতে সেই ঐক্য গড়া না গেলে বিআরআই একটি সংকীর্ণ চীনা উদ্যোগ হিসেবেই থেকে যাবে। এটিকে এখন যেভাবে অন্যদের ওপর চীনা পছন্দ চাপিয়ে দেওয়া প্রকল্প হিসেবে ভাবা হয়, সেই অবস্থা থেকে অবশ্যই সরে আসতে হবে।
ব্রিকসের মধ্যে সৌদি আরব ও ইরানের সম্ভাব্য অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও একই কথা বলা যায়। রাশিয়া ছাড়াও এই দুটি তেল উৎপাদনকারী দেশ ব্রিকসে থাকলে ডলার ছাড়া অন্য আরও কিছু মুদ্রায় আরও কিছু তেল কেনাবেচার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সর্বোপরি ব্রিকস এবং ব্রিকস-প্লাসের যেকোনো সদস্যকে ডলারের সামনে কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হলে তাকে অবশ্যই বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকারীদের যখন খুশি তখন ওই দেশের মুদ্রায় সম্পদ কিনতে ও বেচতে দিতে হবে। অর্থাৎ চীন যেভাবে বিধিনিষেধ দিয়ে কঠোরভাবে তাদের দেশে পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করে, সে ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে না।
সর্বোপরি, যতক্ষণ না ব্রিকস এবং সম্ভাব্য ব্রিকস-প্লাসভুক্ত দেশগুলো তাদের নিজস্ব সঞ্চয়ের জন্য ডলারের একটি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প খুঁজে না পাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ডলারের আধিপত্য নিঃসন্দেহে বহাল থাকছে। সূত্র: প্রথম আলো।
এসডব্লিউএসএস/১২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ