পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা দিনদিন বেড়েই চলেছে। অপরাধীদের সাথে হাত মিলিয়ে পুলিশের অপকর্মের তালিকাটাও বেশ বড়। সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করে ডাকাতি ছিনতাই, থানায় লটকিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা, থানায় মামলা করতে গিয়ে হয়রানির শিকার সহ অসংখ্য উদাহরণ তৈরী হয়ে আছে। সেই তালিকায় এবার যোগ হলো পুলিশের আরেকটি অপকর্ম। অভিযোগ, দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার আহত বৃদ্ধ দম্পতির মামলা নিচ্ছে না চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার ওসি। হতাশ পরিবারটি বুঝে উঠতে পারছেন না মামলা নিতে পুলিশের এমন অনীহার কী কারণ আছে।
জানা যায়, গত ১২ ডিসেম্বর সকালে নিজের বসতভিটার পেছনে কয়েকটি মেহগনিগাছে পানি দিচ্ছিলেন রূমালী বেগম। তাদের প্রতিবেশী সাত্তার ও আফসাররা বাঁশ কেটে কঞ্চি ফেলে রেখেছিলেন হুমায়ুন আলীর জায়গাতে। স্ত্রী রূমালী বেগম সেই কঞ্চিগুলো কিছুটা সরিয়ে দেন তাদের জায়গা থেকে। এতেই ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে সাত্তার, আফসার, সাত্তারের ছেলে সেলিম, আফসারের ছেলে তারিকুল ও তাদের আত্মীয় দানেশ মল লোকজনসহ এসে রূমালী বেগমকে প্রথমে লাথি-কিল-ঘুষি ও পরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেন। খবর পেয়ে স্ত্রীকে বাঁচাতে ছুটে যান বৃদ্ধ হুমায়ুন আলী। হামলাকারীরা তাকেও বেধড়ক মারপিট ও বেদম লাঠিপেটা করেন। এ সময় হুমায়ুন আলীর মাথা ফেটে রক্তাক্ত জখম হন। স্ত্রী রূমালী বেগমও গুরুতর জখম হন। হামলাকারীরা তাদের সেখানেই ফেলে রেখে বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এদিকে প্রকাশ্যে এ হামলার ঘটনা ঘটলেও গ্রামের কোনো মানুষ সাহস করে বৃদ্ধ দম্পতিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসতে পারেননি। খবর পেয়ে জামাই আনিসুর রহমান আধাঘণ্টা পর গ্রামে এসে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ও পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন।
সেখানে আট দিন চিকিৎসা শেষে ১৯ ডিসেম্বর দম্পতিকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। হাসপাতালের ছাড়পত্রে বৃদ্ধ হুমায়ুন আলীর মাথায় গুরুতর জখম ও রূমালী বেগমের বাম পায়ের একটি হাড় ভেঙে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে আরও জানা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ ডিসেম্বর হুমায়ুন আলী বাদী হয়ে হামলাকারীদের ৬ জনের নাম উল্লেখ করে শিবগঞ্জ থানায় এজাহার পাঠান। এজাহার জমা নিয়ে শিবগঞ্জ থানার ওসি ফরিদ উদ্দিন থানার এএসআই নুরুল ইসলামকে প্রাথমিক তদন্তের দায়িত্ব দেন। এএসআই নুরুল পর দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ওসিকে প্রতিবেদন দেন।
দম্পতি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেন থানায়। হামলার শিকার দম্পতির এজাহারটি মামলা আকারে রেকর্ড করেননি।
হামলায় রূমালী বেগমের একটি পা ভেঙে গেছে। ৮ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে বাড়ি ফিরলেও অজ্ঞাত কারণে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা নেননি শিবগঞ্জ থানার ওসি। অসহায় এ বৃদ্ধ দম্পতি হামলাকারীদের অব্যাহত হুমকির মুখে চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে ছেলেসন্তান না থাকায় দম্পতির জামাই আনিসুর রহমান বাবু প্রায় প্রতিদিনই থানায় ঘুরছেন। ওসি বলছেন মামলা হবে। কিন্তু গত ২০ দিনেও মামলা রেকর্ড করেনি ওসি। আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না হওয়ায় চরম আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন ওই দম্পতি। হতাশ পরিবারটি বুঝে উঠতে পারছেন না মামলা নিতে পুলিশের এমন অনীহার কী কারণ আছে।
অন্যদিকে হামলাকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন গ্রামে। বুড়োবুড়িকে শেষ করে দেয়ার কথাও প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। হামলাকারীরা তাদের প্রাণে শেষ করে ২০ লাখ টাকা খরচ করবেন বলেও ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভুক্তভোগী একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে অভিযোগে বলেন, শিবগঞ্জ থানার বর্তমান ওসি যোগদানের পর থেকে অনেক গুরুতর অভিযোগের ঘটনাতেও মামলা নিতে অনীহা দেখিয়ে আসছেন। ফলে ভুক্তভোগী লোকজন প্রতিকার ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে এমন হামলার ঘটনাও বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ নতুন কোনো ঘটনা নয়। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকদের সঙ্গে থানার পুলিশদের এক অজানা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার ফলে তারা বীরদর্পে অপরাধ করে বেরালেও থানা পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেকে মনে করেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে গিয়ে পুলিশের মামলা নেওয়ার ঘটনা বিরল। তাদের মাঝে আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসার অংশীদারিত্ব থাকে বলেও জানান তারা।
গতকালই পুলিশের চক্রান্তের শিকার হয়ে বিনাদোষে পাঁচ বছর সাজা কেটে অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন আরমান বিহারী নামে পল্লবীর বেনারসীর এক কারিগর। মাদক ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন বিহারীকে বাঁচাতে আরমানকে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে কারাগারে রেখেছিলেন বলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। গতকাল হাইকোর্ট তার সত্যতা পেয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
এরকম অজস্র ঘটনা আছে। আইন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, পুলিশের চক্রান্তে বিনাদোষে জেল খাটা সহ পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুবরণ, নির্যতনের শিকার এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালীদের রক্ষার্থে পুলিশের মামলা না নেওয়া প্রচলিত এক ঘটনা বলে হতাশা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডাব্লিউ/ডিজে/কেএইচ/১৬৩৫
আপনার মতামত জানানঃ