স্টেটওয়াচ সম্পাদনা পরিষদ : নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে এক বছর পার করেছে বিশ্ব। টিকা আশাবাদ সৃষ্টি করেছে যে, মানুষ হয়তো এই বিপর্যয় থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসতে পারবে। তবে আর্থিক সক্ষমতার দ্রুত বিকাশ নীতিনির্ধারকদের যতটা আশাবাদী করে তুলছে, সামাজিক ও ব্যক্তির মানসিক ক্ষেত্রে উন্নতি ততটা সুখকর নয়। কোভিড ভাইরাসকে মোকাবিলা করা গেলেও ধারণা করা হচ্ছে, এর সামাজিক ও মানসিক রেশ বইতে হবে দীর্ঘদিন। ২০২০ সাল করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে। এখন বিশ্বজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি হতাশার শঙ্কা হাজির হচ্ছে।
দেশে দেশে করোনাউত্তর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগে লাভবান হয়েছে প্রধানত বড় ধনীরা। সম্পদ বেড়েছে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকারের প্রণোদনার উদ্যোগ ধনীরা কাজে লাগাতে পারলেও গরিবদের সে ঋণ না দিতে সব চেষ্টাই চালিয়েছে ব্যাংকগুলো। দফায় দফায় ঘোষণাপত্র জারি করেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি সাধনে সক্ষম হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রণোদনা, সংস্কার ও পুনর্গঠন কার্যক্রমে বড় ধনীদের তোষণ এবং দুর্দশার মধ্যেও ধনীদের অবিশ্বাস্য গতিতে সম্পদ অর্জন- এই দুটো ব্যাপারই বিশ্বজুড়ে ৭০০ কোটি মানুষের হতাশা উস্কে দিতে যথেষ্ট।
ভালো বেতনের স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে ফ্রিল্যান্স, পার্ট টাইম অথবা ঘণ্টা চুক্তিতে নতুন কর্মী নিয়োগের মধ্য দিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের লভ্যাংশ ও শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং (এআই/এমএল) বিস্তারের পাশাপাশি শ্রম প্রতিস্থাপন, বড় পুঁজি ও দক্ষ জনবলনির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহারের ধারা বেড়ে চলেছে এই কর্মহীনতার মধ্যেই। কিন্তু পুঁজিপতিদের মুনাফার লোভ নিয়ন্ত্রণের কথা কোনো দেশের রাজনীতিকরাই বলছেন না। মুনাফার চেয়ে এ সময়ে যে পারস্পরিক সহযোগিতা বেশি জরুরি, পুঁজিপতি, উদ্যোক্তা তথা প্রতিষ্ঠান মালিক বা নিয়োগকর্তাদের সেটা বুঝানো যায়নি।
উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে কভিড-১৯ যে মন্দা সৃষ্টি করেছে তা বিশ্বব্যাংকের ভাষায় ‘প্যানডেমিক ডিপ্রেশন’। অর্থাৎ এক ধরনের হতাশার মহামারী মূল করোনাভাইরাসের মতোই ছড়িয়েছে। এই মহামারি ১০০ কোটির বেশি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে, যাদের দৈনিক আয় এখন দুই ডলারের নিচে। এই বিপুল মানুষ তাদের দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় আছেন। কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সহযোগিতা ও ভরসা পাচ্ছেন না।
মধ্য ও দরিদ্র্য পরিবারগুলো নতুন অনেক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ফলে তারা ব্যয় কমিয়ে মানবেতর অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এই ভোগের ঘাটতি আবার কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও মুনাফাকেও প্রভাবিত করছে। বেসরকারি ও করপোরেট খাতেও উচ্চঋণের বোঝা যুক্ত হয়েছে। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের সম্পদ বিক্রি করছে কিংবা সঞ্চয় ভাঙিয়ে খাচ্ছে। এটাও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার আরেক নিয়ামক।
ম্যাক্রো অ্যাসোসিয়েটসের প্রধান নির্বাহী নুরিয়েল রুবিনি সম্প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন চলমান দুর্দশার উন্নয়ন ঘটাবে না; এমনকি সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে ৭৭০ কোটি মানুষের কাছে সমানভাবে ভ্যাকসিন পৌঁছলেও না। খুব জোর দিয়ে বলা উচিত নয়, কিন্তু অবকাঠামোগত সক্ষমতা (কোল্ড স্টোরেজ), ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর উত্থান ও গুজবের মতো বিষয়গুলো জনমানুষের মাঝে ভ্যাকসিন ভীতি তৈরি করবে। উপরন্তু নেতৃস্থানীয় ভ্যাকসিনগুলো ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর বলা হলেও তা প্রাথমিক ও অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
ভ্যাকসিন নিয়ে আশাবাদ যেমন আছে, তেমনি হতাশার শঙ্কাও কম নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রবল শঙ্কা রয়েছে। ভ্যাকসিন পাওয়া না পাওয়া নিয়েও হতাশা উচ্চস্তরে পৌঁছতে পারে। তাছাড়া ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত লোকেরা যখন মাস্ক ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবেন, তখন ভ্যাকসিন না পাওয়া মানুষদের সঙ্গে তাদের সামাজিক ও মনোজাগতিক পার্থক্য ও এর ওপর ভিত্তি করে বৈষম্যও তৈরি হবে।
বিদায়ী বছর বড় সংকট সামনে নিয়ে এলেও সেরকম কোনো সমাধান দেখাতে পারেনি। রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন কিছু ঘটেনি। বড় রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে মার্কিন নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়লাভকে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে অর্থনীতিতে এটি কোনো বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি করবে না। নতুন নেতৃত্বের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চেষ্টা করবে বাণিজ্যযুদ্ধ কমিয়ে আনতে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে পুনরায় যুক্ত হতে এবং বাণিজ্যজোটের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, যুক্তরাষ্ট্রে যে ৫০ পরিবার অর্ধেক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে নবনির্বাচিত সরকারের পদক্ষেপ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক হবে। যা কিনা সে দেশের মানুষের মধ্যে হতাশা আরো বাড়িয়ে দেবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান শীতল যুদ্ধ আরো ঘনীভূত হবে, যা তাইওয়ানে সামরিক সংঘাত অথবা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্য বিস্তারের দিকে পরিস্থিতিকে ধাবিত করবে। ভবিষ্যতের শিল্পগুলোকে নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হওয়ার সাথে সাথে ফাইভজি, এআই/এমএল, বিগ ডাটা, ইন্টারনেট অব থিংস, কম্পিউটার চিপস, অপারেটিং সিস্টেম এবং অন্যান্য প্রথম সারির প্রযুক্তিনির্ভর ডাটা, তথ্য ও আর্থিক প্রবাহ, মুদ্রা, অর্থ প্রদানের প্লাটফর্ম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় রাষ্ট্রসমর্থিত সাইবার অপরাধ বেড়ে যেতে পারে।
অসম সমাজ ব্যবস্থা, দুর্যোগকে মুনাফা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কর্মহানীর উপায় বানানো, মুনাফার জন্য ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত বৃদ্ধি এবং গুরুতর ও নিয়মিত মানবসৃষ্ট দুর্যোগের পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীবজগতের বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের ফলে সৃষ্ট জৈবিক মহামারির মতো বিষয়গুলো ২০২১ সালে বিশ্ববাসীর কঠিন পরীক্ষা নেবে। তবে এই বিশৃঙ্খলাই আবার মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করছে। তাই আশা নিয়ে আমরা ২০২১ সালের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি, যেন মানুষ জেগে ওঠে! যেন এই হতাশার ভাইরাসকেও হারিয়ে দিতে পারে আগামী দিনগুলো।
হতাশা ও শঙ্কা থাকলেও ইতিবাচক পরিবর্তনের আশায় বেঁচে থাকে মানুষ। নতুন বছর নতুন অগ্রগতি বয়ে আনবে এমন কামনার পাশাপাশি পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের স্টেটওয়াচের পক্ষ থেকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। স্বাগত ২০২১ ইংরেজি বর্ষ।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ