প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বা দ্য গ্রেট ওয়ার ঠিক কী কারণে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা দায় নিজেদের কাঁধে নিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ইতিহাসবিদই মনে করেন, একটি খুনের ঘটনা ঘিরে বেশ কিছু জটিল সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার জের ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।
১৯১৪ সালের জুনে অস্ট্রিয়ার রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ তাঁর স্ত্রী সোফিকে নিয়ে বসনিয়া সফরে যান। বসনিয়া ছিল তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের দখলে।
ওই দম্পতি ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে অবস্থানরত অনুগত সেনাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। এদিন ছিল তাঁদের বসনিয়া সফরের শেষ দিন এবং দিনটি ছিল রোববার। দিনটি ফার্দিনান্দ ও সোফির জন্য ছিল বিশেষ তাৎপর্যময়। কারণ, এই রাজদম্পতির ৪০তম বিবাহবার্ষিকীও ছিল সেদিন।
প্রেম করে নিচের স্তরের কাউকে বিয়ে করার কারণে ফার্দিনান্দ ও সোফি কখনো অস্ট্রিয়ায় স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারেননি (রাজপরিবারের কড়া নিয়মকানুনের কারণে)। কিন্তু রাজত্ব থেকে অনেক দূরে বসনিয়ায় সেই নিয়ম বলবৎ ছিল না বলে সোফি সেদিন ছিলেন অনেকটাই খুশি এবং তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে বেশ কিছু ছবি তুলেছিলেন। এই সফরে সোফি দারুণ খুশি থাকলেও বসনিয়ার অনেক মানুষ তখন তাঁদের আগমনে ক্ষুব্ধ ছিল। গন্তব্যস্থলে যাওয়ার সময় পথেই সার্বিয়ান সন্ত্রাসীদের ছোড়া হাতবোমা থেকে তাঁরা অল্পের জন্য বেঁচে যান।
এই যাত্রায় বেঁচে গেলেও দিনের আরও পরের দিকে আরেকটি হামলায় ভাগ্য তাঁদের সহায় হয়নি। সার্বিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী গাভরিলো প্রিন্সিপের ছোড়া বুলেটে মারা যান ফার্দিনান্দ ও সোফি। প্রিন্সিপের বয়স তখন মাত্র ১৯ এবং তিনি ছিলেন এক দরিদ্র কৃষকের সন্তান। ইউরোপে তখন আততায়ীদের হাতে এমন প্রাণনাশের ঘটনা বিরল না হলেও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য এ খুনের ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় এবং জার্মানির সহায়তায় এক মাসের মাথায় ২৮ জুলাই তারা সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, দখল করে নেয় বেলজিয়াম ও ফ্রান্স। রাশিয়া তখন ছিল সার্বিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র। এসব ঘটনা ব্রিটেনের মোটেও পছন্দ হয়নি। তারা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। এক দেশ অন্য দেশ দখল করার মতো ঘটনা ইউরোপে মোটেও নতুন কিছু ছিল না। এসব ঘটনা ছিল তারই প্রতিফলন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপজুড়ে পুরোদমে শিল্পবিপ্লব চলছিল। তেল, গ্যাস, কয়লা ও আরও মূল্যবান খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ নতুন নতুন অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নতুন শিল্প ও উৎপাদন–প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন ৫টি মহাদেশব্যাপী বিস্তৃত ছিল এবং আফ্রিকার অনেক উপনিবেশ যখন ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন, তখন উপনিবেশ স্থাপনের এই খেলায় জার্মানিও ভালোভাবে শরিক হতে চাইছিল।
উপনিবেশক হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব আরও দৃঢ় করতে মরিয়া দেশগুলোর একে অপরের সঙ্গে উত্তেজনা বেড়েই চলছিল। সমমনা দেশগুলো তখন ইউরোপে নিজেদের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে একে অপরের সঙ্গে জোট (অ্যালায়েন্স) গঠন করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইউরোপের দেশগুলো তাদের সামরিক শক্তি বাড়াতে উদ্যোগী হয় এবং প্রয়োজনে তাদের সেই সামরিক শক্তি প্রদর্শনে উৎসাহিতও হয়। ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলোর সবারই শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ছিল এবং তারা ধীরে ধীরে নিজেদের সামরিক বাহিনীকে আরও প্রস্তুত করার লক্ষ্যে যা যা করা দরকার, সবই করছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপজুড়ে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক উত্থান হয়। মানুষ তাদের দেশ ও সংস্কৃতিকে অতিমূল্যায়ন করতে শুরু করে। মরিয়া হয়ে ওঠে উপনিবেশক শক্তির হাত থেকে যেকোনো মূল্যে মুক্তি পেতে। মনে করা হয়, এই তীব্র জাতীয়তাবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একটি সাধারণ কারণ। যেমন ১৮৭০-৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধে জার্মানি ফ্রান্সকে পরাভূত করেছিল। জার্মানির কাছে ফ্রান্স বিপুল অর্থ ও ভূমি খুইয়েছিল। এ ঘটনা পরে ফরাসি জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয় এবং জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের জন্য জনমত তৈরি হয়।
আর্চডিউক ফার্দিনান্দও উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণেই খুন হয়েছিলেন। তাঁকে গুলি করেছেন যে প্রিন্সিপ, তিনি ছিলেন সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য, যারা বসনিয়ার ওপর অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের শাসন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। বসনিয়ার কৃষকেরা তখন নিদারুণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন, দিনের পর দিন শোষণের ভারে তাঁরা ছিলেন একেবারে পর্যুদস্ত। এসব ভয়ংকর দিন পরিবর্তনের জন্য কেউ যখন কিছু করছিল না, তখন দেশটির একদল তরুণ নিজেরাই কিছু একটা করতে উদ্যোগী হন। প্রিন্সিপ ছিলেন এই ‘বিপ্লবী’ দলের একজন।
মোট কথা, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর সে বছরের আগস্ট মাসে ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জার্মানি। দ্রুততম সময়ে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গ্রেট ব্রিটেনও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সে সময়ের সব কটি প্রভাবশালী দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। অক্টোবর মাসে যখন প্রিন্সিপের বিচার শুরু হলো, ততক্ষণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে।
দ্য গ্রেট ওয়ার বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক এবং রাসায়নিক অস্ত্রের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে যুদ্ধে প্রাণ যায় প্রায় ৯০ লাখ মানুষের!
আপনার মতামত জানানঃ