মূল্যস্ফীতির চাপ, আর্থিক সংকট ও বিনিয়োগে নানা শর্তের কারণে কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ফলে আগের কেনা সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির পর যে হারে ভাঙানো হচ্ছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে না। যার কারণে ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না বেড়ে কমেছে অর্থাৎ ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশের একটা বড় সংখ্যক সাধারণ মানুষের কাছে জমানো টাকার লাভজনক ও নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র। কিন্তু সম্প্রতি নতুন করে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের চেয়ে পুরনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটা সময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে বেশিরভাগ গ্রাহক আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু এখন যাদের সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হচ্ছে তারা আর নতুন করে এখানে বিনিয়োগ করছেন না। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এখন বিক্রির চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ বেশি করা হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র ভাঙার হিড়িক কেন?
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগসীমা। তাই মেয়াদ শেষে অনেকেই আর নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। এটাও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার বড় কারণ।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের পরিচালক মো: শাহ আলম জানান, সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার খুব বেশি কমে নাই, কিন্তু সমস্যা হল নগদায়নের হার বেড়ে গেছে। অর্থাৎ টাকা তুলে ফেলার একটা প্রবৃত্তি আছে মানুষের মধ্যে।
২০২১ সালে সরকার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে দিলে অনেকেই এতে বিনিয়োগে আগ্রহ হারায়। তার উপর গত বছর যোগ হয় বেশ কিছু নতুন নিয়ম-নীতি।
তখন সঞ্চয় অধিদপ্তর জানায় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে লাগাম টেনে ধরা উদ্দেশ্য তাদের। উদ্দেশ্য সফলও হয়। গত বছর থেকেই কমছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ।
আর এর বড় কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কথা উল্লেখ করছেন।
একসময় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা টাকা থেকে যে সুদ আসতো তা দিয়ে সংসারের অনেকটা ব্যয় নির্বাহ হলেও বর্তমান বাজারে সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না।
একইসাথে মানুষের সঞ্চয় সংকুচিত হয়ে আসছে বলে মত সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের।
তিনি জানান, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে ইনকাম বাড়ছে না, ফলে সবই তো খরচ করে ফেলতে হচ্ছে। মানুষ তখনই সঞ্চয় করবে যখন তার হাতে অতিরিক্ত রোজগার থাকে, আর সাধারণ মানুষ, যারা মধ্যবিত্ত, তাদের বিনিয়োগ করার অন্য তো কোন জায়গা নেই, একমাত্র সঞ্চয়পত্রটাই আছে। সঞ্চয় না থাকলে তো এটা করা যাবে না।
সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারকে বিপুল টাকা খরচ করতে হয়। সাধারণত জনগণের করের টাকা থেকে এই সুদের টাকা পরিশোধ করা হয়। এজন্য গত বছর সরকার নিয়মও বেঁধে দেয় যে ৫ লাখ টাকার উপর সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক। যা নিরুৎসাহিত করে অনেককেই।
স্বামীর অবসরের পর পেনশনের টাকায় একসাথে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন নুরজাহান বেগম। কিন্তু পরে ভেঙে ফেলেন সেটি তিনি। তিনি জানান, প্রথমে ১০ লাখ একসাথে রাখছিলাম। টাকাও বেশি আসতো। পরে ভেঙে ৫ লাখ রাখছি এখন
সুদের হার কমানো ও আয়কর রিটার্ন দাখিল ছাড়াও সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার একটা সীমাও বেঁধে দিয়েছে সরকার। সেটাও নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
তবে বর্তমান অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলার পেছনে মূল্যস্ফীতিকেই প্রধান কারণ মনে করছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর।
মো: শাহ আলম বলেন, এখন আসলে সঞ্চয়পত্রে খুব একটা লাভবান হচ্ছে না মানুষ। কারণ ইনফ্লেশনটা দেখেন ৯ শতাংশের মতো। সরকার সুদ দিচ্ছে ১১%! তার নিট লাভ ২%, বেশী না তো। ফলে সারভাইভ করার জন্য যেটুক জমা আছে, সেটুক তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতাটা এই অর্থবছরে বিশেষ করে বেশি দেখছি।
একই মত অর্থনীতিবিদ ফাহমিদা খাতুনের। তবে একইসাথে তিনি বলছেন বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে তারা ইনভেস্ট করতে পারে।
আর এই মূহুর্তে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে মানুষকে উৎসাহিত করার মত কোন খবর দিতে পারছে না জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর।
এসডব্লিউএসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ