‘মুতাজিলা’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘ইতিজাল’ শব্দ থেকে। এর অর্থ পৃথক হওয়া। তাদের ‘মুতাজিলা’ বলার কারণ হলো, তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত থেকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ওসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর জামালের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ হয় আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে চরম অনৈক্য দেখা দেয়। মুসলমানরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শাহাদাত লাভ করেন অনেক সাহাবা। একে অন্যকে কাফির বলতে শুরু করেন।
বিজ্ঞ আলেমরা যখন দেখলেন, মানুষ অবলীলায় কবিরা গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে, একে অন্যকে কারণ ছাড়া হত্যা করছে, তখন তাঁরা নিজ নিজ গবেষণা অনুযায়ী কোরআন-হাদিসভিত্তিক সমাধান বের করায় আত্মনিবেশ করেন। এর ফলে দেখা দেয় তীব্র মতবিরোধ। কবিরা গুনাহকারীর ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের রায় হলো, তারা মুমিন, কাফের নয়। তবে তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। কেননা কবিরা গুনাহকারীর বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকে। আর এটাই ঈমানের মূল বিষয়।
অন্যদিকে খারেজিদের অভিমত হলো, কবিরা গুনাহকারী কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামি। আর মরজিয়া মতবাদের অনুসারীদের বক্তব্য হলো, কবিরা গুনাহকারী মুমিন এবং গুনাহর ব্যাপারে তারা ক্ষমার আশাবাদী। এভাবে বিরোধ ছড়িয়ে পড়ে এবং বসরার মসজিদে মসজিদে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। হাসান বসরি (রহ.)-এর মজলিসটি তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল। হাসান বসরি (রহ.)-এর শিষ্য ওয়াসিল ইবনে আতা চিন্তা করেন যে তিনি এ বিষয়ে সবার চেয়ে উৎকৃষ্ট সমাধান দেবেন! তিনি হাসান বসরির বৈঠকে বলেন, ‘কবিরা গুনাহকারী মুমিন নয়, কাফিরও নয়; বরং তারা ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী।’
এ কথা বলে তিনি হাসান বসরি (রহ.)-এর মজলিস থেকে উঠে যান এবং নিজের এই মতবাদ প্রচার করতে শুরু করেন। এরপর হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘ওয়াসিল আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে’।
তখন থেকে ওয়াসিল ও তার অনুসারীদের নাম ‘মুতাজিলা’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এ মতবাদ প্রকাশের মাধ্যমে উভয় পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারণ আলী (রা.)-এর পক্ষ আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণকারীদের কাফির বলছিল। অন্যদিকে মুয়াবিয়া (রা.)-এর পক্ষ আলী (রা.)-কে অভিশাপ দিচ্ছিল।
এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলে তারা খুব একটা সফল হয়নি। বরং ইসলামী আকিদা পরিপন্থী তাদের নতুন এ মতবাদের জবাব দিতে গিয়ে আরো বেশি মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ে। নির্ভরযোগ্য অভিমত অনুযায়ী, এটিই মুতাজিলা মতবাদের সূচনাকাল। যদিও মুতাজিলাদের দাবি, তাদের মাজহাবের যাত্রা ওয়াসিলের অনেক আগে—আলী ইবনে আবি তালেব (রা.)-এর হাত ধরে।
তাঁর কাছ থেকে তাঁর পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফি এ মতবাদ গ্রহণ করেন। তারপর উত্তরাধিকারসূত্রে পান তাঁর পুত্র আবু হাসেম, যিনি ওয়াসিল ইবনে আতার শিক্ষক। তবে তাঁদের এ দাবির পক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। মূলত ওয়াসিল ইবনে আতার মাধ্যমেই ১০৫ থেকে ১১০ হিজরির মধ্যে মুতাজিলা মতবাদের সূচনা ও প্রসার হয়। মদিনা থেকেই এ মতবাদ যাত্রা শুরু করে। কেননা তারা মুহাম্মদ ইবনে হানিফা ও আবু হাসেমকে এ মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে দাবি করে। আর তাঁরা দুজনই মদিনায় থাকতেন।
ওয়াসিল মদিনায় জন্ম গ্রহণ করেন এবং আবু হাসেমের কাছ থেকে এ মতবাদ গ্রহণ করেন। তারপর একে মদিনা থেকে বসরা নিয়ে আসেন। মুতাজিলা মতবাদ বসরা নগরীতে প্রবর্তিত হয়।
তৎকালীন সিরিয়া, মিসর, ইরাক ও পারস্যে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজকদের মুসলমানদের একত্রে বসবাসের ফলে ইসলামী আকিদায় ভিন্ন শাস্ত্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সে সময় ব্যাপকভাবে গ্রিক, লাতিন, পারস্য ও ভারতীয় নানা শাস্ত্রীয় গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়। একটি দল তখন এসব শাস্ত্র-দর্শনের প্রভাবে কোরআন-হাদিসের চেয়ে শুধু যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।৷ এরাই মুতাজিলা। ইহুদিদের অনেক আকিদার সঙ্গে মুতাজিলাদের মিল রয়েছে।
যেমন—মুতাজিলাদের উল্লেখযোগ্য একটি আকিদা হলো, খালকে কোরআন বা কোরআন সৃষ্ট হওয়ার আকিদা। ইবনুল আসির (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘খালকে কোরআন’-এর প্রথম প্রবক্তা হলো লাবিদ ইবনে আসাম। আর সে ছিল ইহুদি। এভাবে অন্য দর্শন ও শাস্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তারা নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে। কোন কোন মুতাজিলা পৃথিবীতে মন্দ বা অনিষ্টের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন আল্লাহ কোন মন্দ কিছু করেন না। তাই পৃথিবীতে যা আছে সবই কল্যাণকর।
পরবর্তীতে মুতাজিলা চিন্তাবিদ আন নাজ্জাম বলেন আল্লাহ শুধু মন্দ করেন না এমন নয়, বরং আল্লাহ মন্দ করতে পারেন না৷ যা কিছু মন্দ অনিষ্ট তা মানুষই করে। এটা সব মুসলমানই স্বীকার করেন যে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা মুসলিমদের কর্তব্য। তবে মুতাজিলারা এটাকে ‘ফরজে আইন’ বা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করেন।
পবিত্র কুরআনের মতে, জগত বিশেষ সময়ে সৃষ্টি হয়েছে তবে মুতাজিলারা মনে করেন, জগত চিরন্তন তবে তা বাস্তব আকারে ছিলো না। অনন্তকাল ধরে জগত নিশ্চল-নিস্তব্ধ আকারে ছিলো। আল্লাহ নিজ শক্তিতে সেটাকে গতিশীল করেছেন৷ এবং তখন থেকেই জগত স্থান কালের আবর্তে আবর্তিত হয়ে চলছে।
যুক্তিবাদী মুতাজিলাগণ যুক্তি দ্বারাই ইসলামের সব বিশ্বাসকে বিচার করেন। যুক্তি বহির্ভূত ব্যাখ্যাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তারা প্রায়শই এই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন যে যুক্তির সীমাবদ্ধতা আছে। শুধু যুক্তি দিয়ে সত্তার পূর্ণ সত্য উন্মোচিত হয় না। হওয়া সম্ভবও নয়। ২১২ হিজরিতে খলিফা মামুন ‘পবিত্র কোরআন আল্লাহর বাণী নয়; বরং তা সৃষ্ট’—মুতাজিলাদের আলোচিত এ আকিদার প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। আলেম, মুহাদ্দিস, ফিকাহবিদ ও বিচারকদের প্রতি নির্দেশনা পাঠানো হয়—কেউ ‘খালকে কোরআন’ স্বীকার না করলে তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে বহু আলেম চুপ হয়ে যান।কিন্তু আরো বহু আলেম সত্য তুলে ধরতে পিছপা হননি। এতে তাঁদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় মুতাজিলাদের এটি ছিল সবচেয়ে বৃহত্তম ও নিকৃষ্টতম প্রচেষ্টা। প্রচলিত ধারানির্ভর কালাম শাস্ত্র প্রয়োগের এগারো শতকের অন্যতম সেরা আশআরী ঘরানার আলেম ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রাহঃ।
তিনি লক্ষ্য করেন যে মুসলিমরা মুতাজিলাবাদ নামে ভ্রান্ত এক ধারণার দ্বারা আক্রান্ত। তাই তিনি কালাম শাস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে প্রচলিত মূলধারার ইসলামকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন এবং জনসাধারণকে আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজেদের সমর্পণে উদ্বুদ্ধ করেন। আল-গাজ্জালির উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল তিনি কখনোই মুতাজিলাদেরকে শারীরিকভাবে আঘাত করেননি। লেখালেখির মাধ্যমেই তাদের ভ্রান্ত ধারণার নিরসন ঘটিয়েছেন।
আল গাজ্জালির ইন্তেকালের পরে মুতাজিলাবাদ পরিপূর্ণভাবে দূরীভূত হয়নি ঠিক, তবে তারা আর মতবাদকে ছড়ানোরও সুযোগ পায়নি। গ্রহণযোগ্যতার তলানিতে ঠেকে একদা পরাক্রমশালী এই মতবাদ।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ