আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও আমাদের সামনে সেই বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যেখানে একই সঙ্গে উদ্বেগ আর প্রত্যাশা দু’টোই আছে। প্রত্যাশা আছে কারণ, বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেই আমরা এতদিন ধরে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করেছি। তাই নতুন বুদ্ধিমত্তা আমাদের জন্য আশার বিষয়। আর চিন্তার কারণটি হলো, আমরা ইতিমধ্যে আশঙ্কা করতে শুরু করেছি, মেশিন লার্নিং আমাদের বিজ্ঞানকে অধপাতের দিকে নিয়ে যাবে এবং এটি আমাদের নৈতিকতাকে দুর্বল করে দেবে।
ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি, গুগলের বার্ড, মাইক্রোসফটের সিডনি মেশিন লার্নিংয়ের বিস্ময়কর রূপ। এসব এআই টুল প্রচুর পরিমাণ ডেটা থেকে নির্দিষ্ট ছন্দ তথা প্যাটার্ন খুঁজে বের করে।
এভাবে পরিসংখ্যানগতভাবে সম্ভাব্য আউটপুট তৈরি করতে শেখে এগুলো। একটা সময় মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বহুদিন ধরেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। শুধু পরিমাণগত দিকেই নয়, গুণগত দিকেও উন্নত হবে এআই। ভবিষ্যতে বুদ্ধিগত অন্তর্দৃষ্টি, শৈল্পিক সৃজনশীলতা এবং অন্যান্য মানবিক স্বতন্ত্র স্থানগুলোতে মানুষের চেয়ে ভালো করবে যন্ত্র।
এখন যে প্রোগ্রামগুলো আমাদের সামনে আসছে সেগুলো সেই অদূর ভবিষ্যতের দিগন্ত দেখতে পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো সেই দিন আসলেই আসবে যেদিন যন্ত্র মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে এখনও সে দিন আসেনি। যদিও এসব বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বাড়িয়ে বলা খবর এবং অপরিমাণদর্শী বিনিয়োগ বাড়ছে। সাধারণ মানুষের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির চলছে। কিন্তু এখনও সেই ভবিষ্যতের দেরি আছে।
বোর্হেস আমাদের নিজেদের ও বিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে যে অনুধাবনের কথা বলেছিলেন তা কখনোই বাস্তব হবে না যদি চ্যাটজিপিটি’র মতো মেশিন লার্নিং পদ্ধতিগুলো আসন গেড়ে বসে। কারণ এগুলো সামান্য কিছু ক্ষেত্রে কাজে দেয়।
যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা ছোটখাটো ছড়ার লাইনের জন্য এই প্রোগ্রামগুলো কাজে দিতে পারে। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের বিজ্ঞান ও জ্ঞানের দর্শন থেকে আমরা এটা জানি যে, মানুষ যেভাবে বিচারশক্তিকে কাজে লাগায় ও ভাষাকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে এ প্রোগ্রামগুলোর বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আর এ পার্থক্যগুলোর কারণেই এসব প্রোগ্রামের সক্ষমতা পিছিয়ে পড়বে।
এটি একই সঙ্গে হাস্যকর এবং দুঃখজনক। বোর্হেস হয়তো এখন এভাবেই বলতেন। এই প্রোগ্রামগুলোর পেছনে এত অর্থ এবং মনোযোগ বিনিয়োগ করা হচ্ছে যা মানুষের মনের তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ। উইলহেল্ম ফন হুম্বোল্ট বলেছিলেন, মানুষের মন ভাষার শক্তিতে ‘সীমিত উপায়ের অসীম ব্যবহার’ করতে পারে। চ্যাটজিপিটি’র মতো এআই টুলগুলোকে মানব মনের সঙ্গে তুলনা করলে কি তুচ্ছই না লাগে!
মানুষের মন মোটেও চ্যাটজিপিটি ও এ রকম অন্য প্রযুক্তিগুলোর মতো কাজ করে না। এগুলো স্রেফ কিছু পরিসংখ্যানিক যন্ত্র যা শত শত টেরাবাইট তথ্য ঘেঁটে সাধারণ কথোপকথনের মতো করে উপস্থাপন করতে পারে। কিন্তু মানুষের মন একটি বিস্ময়কর কার্যকরী ব্যবস্থা যা সামান্য পরিমাণ তথ্য নিয়েও কাজ করতে পারে। এটি বিপুল তথ্য ঘেঁটে এর সারমর্ম করে না বরঞ্চ ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে।
যেমন ছোট বাচ্চা যখন ভাষা শেখে, তখন এটি যৌক্তিক নীতিমালা ও মাপকাঠিসমৃদ্ধ ব্যাকরণের মাধ্যমে তার ভিত গড়া হয়। এ ব্যাকরণকে জন্মগত অভিব্যক্তি, জিনগতভাবে ইনস্টল করা ‘অপারেটিং ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভাষাবিজ্ঞানীরা যখন কোনো একটি ভাষা কেন কাজ করে এ বিষয়ে তত্ত্ব তৈরি করতে চান, তখন তারা সচেতনভাবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ ব্যাকরণেরই একটি বিশদ সংস্করণ তৈরি করেন।
একটি শিশু এ ব্যাকরণ সহজাতভাবেই বুঝতে পারে। সেজন্য তার খুব বেশি তথ্য জানারও প্রয়োজন হয় না। এ শিশুটির অপারেটিং ব্যবস্থা একটি মেশিন লার্নিং প্রোগ্রামের ব্যবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আদতেই এ ধরনের প্রোগ্রামগুলো একেবারেই প্রাকমানব পর্যায়ে আটকে আছে। এগুলোর গভীরতম ত্রুটি হচ্ছে, তারা বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই বুঝতে পারে না। তারা কোনো কিছুর অস্তিত্বকে স্বতন্ত্রভাবে প্রশ্ন করতে পারে না। ধারণা করা কিংবা কোনো কিছু নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার বিষয়টিও তাদের মধ্যে নেই।
অথচ এগুলো হলো বুদ্ধিমত্তার একেবারে প্রথম দিকের বিষয়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন আপনি হাতে একটা আপেল ধরে আছেন। ছেড়ে দিলেন, কী ঘটলো দেখলেন, এবং বললেন, ‘আপেলটা পড়ে গেল।’ এটা হচ্ছে বর্ণনা। আর পূর্বাভাস হতে পারে ‘আমি হাত খুলে ফেললে আপেলটা পড়ে যাবে।’ দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ, আর দু’টোই সঠিক।
কিন্তু যখন এর সঙ্গে ব্যাখ্যা যুক্ত হবে, তখন ব্যাপারটা আরও শক্তিশালী হবে। ওই ব্যাখ্যার মধ্যে বর্ণনা ও পূর্বাভাসের পাশাপাশি আমরা আরও পাবো কাউন্টারফ্যাকচুয়াল অনুমান। এ অনুমান হতে পারে ‘আপেলের মতো অন্য যেকোনো বস্তুও পড়ে যাবে’। এর সঙ্গে আরও বাড়তি তথ্য হিসেবে অভিকর্ষের কথাও আনা যেতে পারে। এটি একটি কার্যকারণ সম্বন্ধ তৈরি করবে। আর এ বিষয়টিকেই আমরা বলি চিন্তন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানুষের চিন্তা মোটেই নির্ভুল নয়। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু কোনো কিছু সঠিক হতে হলে তার আগে ভুল হবেই, এটাই বুদ্ধিমত্তার বিষয়। বুদ্ধিমান প্রাণী শুধু সৃষ্টিশীল ধারণাই তৈরি করে না, তারা গঠনমূলক সামলোচনাও পছন্দ করে। মানুষ সম্ভাব্য ব্যাখ্যা তৈরি করে এবং ভুল সমাধান করে। কিন্তু চ্যাটজিপিটি ও এর মতো প্রোগ্রামগুলো শুধু মুখস্থের কাজটা করতে পারে।
কিন্তু সম্ভবকে অসম্ভব থেকে আলাদা করার ক্ষমতা এগুলোর নেই। মেশিন লার্নিং সিস্টেমগুলো সবসময় অগভীর ধারণা দেবে। একটি বাক্যকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এটি একই ধরনের অন্য বাক্যের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করবে। কিন্তু বাস্তবে ওই বাক্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো অর্থও প্রকাশ করতে পারে। ভাষার সঠিক ব্যাখ্যা একটি জটিল বিষয় এবং স্রেফ বিপুল পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করে কোনো এআই টুলকে ভাষার মর্মার্থ বোঝানো সম্ভব হবে না।
প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা নৈতিকভাবেও চিন্তা করতে পারে। আমরা নৈতিকতার বিচারে অনেক কিছুই করা থেকে বিরত থেকে আমাদের মননের নেতিবাচক সৃজনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করি। সকলের জন্য ব্যবহারোপযোগী করতে চ্যাটজিপিটি’কে নৈতিকতার দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকতে হয়। কিন্তু এ ধরনের সমন্বয় অর্জন করতে চ্যাটজিপিটি ও এর মতো প্রোগ্রামগুলোর নির্মাতা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে, ভবিষ্যতেও যেতে হবে।
এসডব্লিউএসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ