অপত্য সৃষ্টি কিংবা ভ্রূণ তৈরির জন্য পুরুষ এবং স্ত্রী—প্রয়োজন পড়ে উভয়ধরনের জিনেরই। তবে পুরুষ জিনের মধ্যেই হাজির থেকে এক্স ও ওয়াই দু-ধরনের ক্রোমোজোমই। কাজেই এই দুই ক্রোমোজোমকে পৃথক করতে পারলেই, কৃত্রিমভাবে ডিম্বাণু তৈরি সম্ভব।
এতদিন পর্যন্ত যে ধারণা কেবলমাত্র তাত্ত্বিকভাবেই সম্ভব ছিল, এবার তাকে বাস্তবায়িত করে দেখালেন জাপানের গবেষক ক্যাটসুহিকো হায়াশি এবং তার সহকর্মীরা।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন পুরুষের দেহকোশকে কাজে লাগিয়েই ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু— উভয় জনন কোষই উৎপাদন করেছেন ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্যাটসুহিকো হায়াশি।
সম্প্রতি বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এ জমা পড়েছে এই বিশেষ গবেষণাপত্রটি। এখনও পর্যন্ত তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত না হলেও, ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বজুড়ে সাড়া পড়ে গেছে এই গবেষণা নিয়ে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামীদিনে এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই নতুন দিগন্ত খুলে যেতে চলেছে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায়। যে-সকল মহিলারা ডিম্বাণু উৎপাদনে অক্ষম, তাঁদের ক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গীর কোশ ব্যবহার করেই তৈরি করা যেতে পারে ভ্রূণ।
তাছাড়া এই সুবিধা উপলব্ধ হলে বিশেষভাবে সুবিধা পাবেন প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষরা। সন্তানধারনের ক্ষমতা পাবেন তাঁরাও।
যদিও এই সাফল্যে পৌঁছাতে কমপক্ষে আরও দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে গবেষকদের। কারণ, সংশ্লিষ্ট গবেষণাটি করা হয়েছে ইঁদুরের জিনকে কাজে লাগিয়ে। পুরুষ ইঁদুরের দেহকোশ থেকেই পৃথক করা হয়েছিল এক্স ও ওয়াই সেক্স ক্রোমোজোম।
তারপর সেই জিন থেকে ওয়াই সেক্স ক্রোমোজোম বাদ দিয়ে, দুটি এক্স ক্রোমোজোমকে সংযুক্ত করে বানানো হয় ডিম্বাণু। দ্বিতীয় পর্যায়ে কৃত্রিমভাবে, অনেকটা টেস্টটিউব বেবি তৈরির পদ্ধতিতে কৃত্রিম ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলন ঘটানো হয় শুক্রাণুর।
তাতে সাফল্য এলেও, ডিম্বাণুর গুণগত মান নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষক। পাশাপাশি, ক্রোমোজোম পৃথকীকরণের এই পদ্ধতি ইঁদুরের এই মানবজিনের ক্ষেত্রে আরও জটিল।
সবমিলিয়ে এখনই এই জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং মানুষের ওপর প্রয়োগ করা নৈতিক দিক থেকে উচিত নয় বলেই মনে করছেন জাপানি গবেষক। তবে প্রযুক্তির উন্নতি আগামী এক দশকে এই অসম্ভবকেও সম্ভব করে দেখাতে পারে বলেই অভিমত তার।
সন্তান জন্ম দিতে বিপরীত লিঙ্গের প্রয়োজন হবে কি হবে না—এমন প্রশ্নের জবাব দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। এর আগে ২০১৮ সালে চীনের একাডেমি অব সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে এক জোড়া নারী ইঁদুর থেকে একটি বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম ঘটিয়েছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, জন্ম নেওয়া ইঁদুরের বাচ্চাটি সুস্থ রয়েছে। এটিই ইঁদুরের সমলিঙ্গের মাধ্যমে জন্ম দেওয়া নতুন বাচ্চা নয়; এর আগে এক জোড়া পুরুষ ইঁদুর থেকে একটি বাচ্চার জন্ম দেওয়া হয়েছিল। তবে সেটি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মূলত একটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। আর তা হলো প্রজননের জন্য দুটি বিপরীত লিঙ্গ কতটা পরিহার্য। কারণ, প্রাকৃতিকভাবেই বিশ্বে এমন কিছু প্রাণি আছে, যেগুলোর বংশ বিস্তারের বিপরীত লিঙ্গের প্রয়োজন হয় না। যেমন: কিছু মাছ, সরীসৃপ, পাখি ও উভচর প্রাণী এ কাতারে রয়েছে।
প্রাণীর বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া, তার কোনটির পরিবর্তন ঘটালে একই লিঙ্গের দুজনকে ব্যবহার করে নতুন প্রাণীর জন্ম দেওয়া সম্ভব—চীনা গবেষকেরা সেটাই জানার চেষ্টা করছিলেন। গবেষণার অংশ হিসেবে তাঁরা একটি মা ইঁদুর থেকে একটি ডিম্বাণু নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় মেয়ে ইঁদুর থেকে নিয়েছেন একধরনের কোষ। বিশেষ এই কোষকে বলা হয় ‘হ্যাপলয়েড অ্যামব্রোয়োনিক স্টেম সেল’।
নতুন প্রাণের জন্ম দেওয়ার জন্য যত জেনেটিক (জিনগত) কোড বা ডিএনএ দরকার, এই দুটিতে ছিল তার অর্ধেক অর্ধেক। কিন্তু দুটিকে মেলানোই যথেষ্ট নয়। বিজ্ঞানীরা ‘জিন এডিটিং’–এর মাধ্যমে এই দুটি থেকে তিন জোড়া করে জেনেটিক কোড মুছে ফেলেছেন—যাতে করে তাদের মধ্যে মিলন সম্ভব হয়।
তবে এ সফলতার পরেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘প্রজননের ক্ষেত্রে দুই বিপরীত লিঙ্গের অপরিহার্যতা রয়েছে। কারণ আমাদের ডিএনএ বা জেনেটিক কোড বাবা নাকি মা, কার কাছ থেকে আসছে, তার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। জেনেটিক কোডের একটি যদি পুরুষ এবং একটি নারী থেকে না আসে, তাহলে আমাদের পুরো শারীরিক-মানসিক বিকাশ গোলমেলে হয়ে পড়ে। অর্থাৎ আমাদের যে ডিএনএ শুক্রাণু থেকে এবং যে ডিএনএ ডিম্বাণু থেকে আসে, তাতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের “ছাপ” থাকে। এটিকে বলে “জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং”। সেটাই আসলে নির্ধারণ করে কীভাবে এই দুইয়ের সংযোগে নতুন কী তৈরি হবে।’
চীনা বিজ্ঞানীরা যখন একই লিঙ্গের ইঁদুর ব্যবহার করে নতুন বাচ্চা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছেন, তখন তাদের জেনেটিক এডিটিং এর মাধ্যমে এই জেনোমিক ইমপ্রিন্টিং বা ছাপ সংশোধন করতে হয়েছে বা মুছে ফেলতে হয়েছে। যাতে করে নতুন ইঁদুর জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়, সেটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়।
এসডব্লিউএসএস/1550
আপনার মতামত জানানঃ