বাংলাদেশে এইচডিআই’র ভিত্তিতে আমাদের অবস্থান কোথায়, তা বহুলভাবে প্রচারিত হয় না। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতির হার, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ, রেমিট্যান্সের পরিমাণ, রপ্তানির পরিমাণ ইত্যাদি যেমন গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হয়, তেমনভাবে এইচডিআই সূচকের খবর প্রচারিত হয় না। তেমনি হয় না আমদানির খবর। রপ্তানির সঙ্গে সঙ্গে আমদানির খবর দিলে বোঝা যেত প্রকৃত পরিস্থিতি কী।
এ কারণেই মানুষের জীবন-জীবিকার অবস্থা বোঝা যায় না, যেহেতু মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বেতন/মজুরি বৃদ্ধির খবর পাওয়া যায় না। জানি না কী ক্ষতি ফলাও করে মজুরি/প্রকৃত মজুরির (রিয়েল ওয়েজ) খবর প্রচার করলে। এটি করা হলে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারতাম, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ২০২২–এর জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয়-ব্যয় নিয়ে জরিপ করেছে। এতে তাদের খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা বাবদ খরচের তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে চাল ও আটার দাম কমেছে।
তবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। তবে এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে দেশের অর্ধেকের (৫৩ শতাংশ) বেশি মানুষ। খাদ্যের দাম বাড়ায় তারা তাদের জীবনযাত্রার অন্যান্য খরচ কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
জরিপে দেখা গেছে, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যতটা খাবার দরকার, তার দাম এক বছরে ১২ শতাংশ বেড়েছে। আর গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে, অর্থাৎ এক মাসে বেড়েছে ৪ শতাংশ।
বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার কেনা বাবদ মাসে মাথাপিছু খরচ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৩৯ টাকা, যা উপার্জন করা গরিবের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
গত সপ্তাহে প্রকাশ করা ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য ৬৮ শতাংশ মানুষের জন্য গভীর দুশ্চিন্তার বিষয়। খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের দাম এক বছরে বেড়েছে ১১ শতাংশ। আর কোভিড সংক্রমণের আগের সময় অর্থাৎ ২০২০–এর মার্চের আগের তুলনায় বেড়েছে ৬১ শতাংশ।
যেভাবে টিকে আছে মানুষ
প্রতিবেদনে বলা হয়, যে ৫৩ শতাংশ মানুষ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে গিয়ে জীবনযাপন ও খাদ্য বাবদ খরচ কমিয়েছে, তারা টিকে থাকতে তিনটি উপায় বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ পরিবার বাকিতে খাবার কিনছে।
৫৩ শতাংশ ঋণ করছে, ১৫ শতাংশ তাদের সঞ্চয় বা জমানো টাকা ভেঙে প্রতিদিনের খরচের জোগান দিচ্ছে। বাকি ৪ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি করছে বা অন্যত্র চলে গিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সার্বিকভাবে মাত্র ১৩ শতাংশ পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাচ্ছে।
খাদ্য নিয়ে চাপে থাকা পরিবারগুলো যতটুকু বাজারসদাই করতে পারছে, তা প্রথমে ঘরের শিশুকে খাওয়াচ্ছে। পরিবারের অন্যরা কম খাবার খাচ্ছে। বিশেষ করে মাছ, মুরগি, ডিম ও ভোজ্যতেলের মতো খাবার খাওয়া তারা কমিয়ে দিয়েছে।
এ কারণে তাদের পুষ্টির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যাতায়াত ও অন্যান্য বিনোদন বাবদ খরচ কমিয়ে দেওয়ায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র মানুষের আমিষের প্রধান উৎস ছিল ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও ডাল। আর ভোজ্যতেল হচ্ছে পুষ্টিকর খাদ্যের অন্যতম উৎস। গত এক বছরে ওই সব কটি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর ফলে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো ন্যূনতম আমিষের চাহিদা মেটাতে পারছে না।
তবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য মজুত আছে। রমজান মাসে আমরা এক কোটির ওপরে পরিবারকে মাসে বিনা মূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেব। আগামী মাস থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু করা হবে। এ ছাড়া ওএমএসের আওতা এবং ট্রাকপ্রতি খাদ্যের পরিমাণও বাড়ানো হবে। ফলে আশা করি, খাদ্য নিয়ে যে সমস্যা চলছে, তা আর থাকবে না।’
সমাধান কোথায়?
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গম, ভোজ্যতেল ও ডালের মতো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কোভিডের প্রভাব এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধকে প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় চালের প্রায় পুরোটা দেশে উৎপাদিত হয়।
এই তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত আমন ধান ওঠার পর বাংলাদেশে চালের দাম কমে। কিন্তু চালের দাম সেই অনুপাতে কমেনি। কারণ, সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।
ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চোখধাঁধানো বড় বড় প্রকল্পের দিকে নজর না দিয়ে সরকারের উচিত দেশের গরিব মানুষের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া। এ জন্য তাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ বেশি নিতে হবে।
নিম্নমধ্যবিত্তদেরও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। কারণ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারাও বড় বিপদে পড়েছে। সেটা ওএমএসের লাইনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
এসডব্লিউএসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ