সুখী দেশের তালিকায় ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপির হার বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, জীবন আয়ুষ্কাল বেড়েছে—তাহলে কেন বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে? তাহলে কি কথিত বা দৃশ্যমান উন্নয়ন মানুষের সুখ কেড়ে নিচ্ছে? জীবনের গুণগত উন্নয়ন কি তাহলে হচ্ছে না?
২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বিশ্ব সুখ জরিপের এক গবেষণায় দেখা গেল, বাংলাদেশ হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ। সেই গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ৪৬তম। আর যুক্তরাজ্য ৩২তম আর ভারত ৫ম অবস্থানে ছিল।
আমি তখন চীনের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত। ক্যাম্পাসে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি। বেইজিংয়ে তখন যে খুব বেশি বাংলাদেশি ছিল তা বলা যাবে না। দক্ষিণ কোরিয়ার এক সাংবাদিক বাংলাদেশি খুঁজতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দপ্তরের সহায়তায় আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সাক্ষাৎকারে প্রশ্নগুলোর মূল বিষয়বস্তু ছিল, ‘কেন বাংলাদেশিরা সবচেয়ে সুখী’। ইনসাইডার নামে একটি ম্যাগাজিনে আমার সেই সাক্ষাৎকারটি কোরীয় ভাষায় ছাপাও হয়েছিল (ভলিউম ৮, মে-জুন ২০০৬)।
সুখকে আমি গুণগত ও আপেক্ষিক বলে জানি। সুখকেও কি বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে পরিমাপ করা যায়? লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের এক দল কল্যাণ-অর্থনীতিবিদের সমন্বয়ে সম্পাদিত ওই জরিপটি নিয়ে সাক্ষাৎকারের আগে এ বিষয়ে আমি কিছুটা পড়াশোনা করি। আমার আগে ধারণা ছিল, অর্থ বা সম্পদ থাকলেই মানুষ সুখী হতে পারে। কিন্তু এ জরিপে ভিন্নতা লক্ষ করা গেল।
ওই জরিপে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি-সম্পর্ক, সুস্বাস্থ্য ও পেশাগত বা চাকরিতে সন্তুষ্টিই ছিল মুখ্য। ওই জরিপে দেখা গেছে, সম্পদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০ বছর ব্যাপ্তিতে মানুষের মধ্যে সুখ কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাজ্যসহ আরও অনেক দেশের তথ্য-উপাত্তে প্রতিফলিত এটা হতে দেখা গেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার ওই ম্যাগাজিনের সাংবাদিককে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের অনুকূলেই আমি কথা বলছিলাম। কারণ, তখনো আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক আন্তসম্পর্ক-সামাজিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বেশ গভীর বলেই জেনেছি। সামাজিক মূল্যবোধ ও শ্রেয়োবোধ বিরাজমান রয়েছে, যদিও তা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত বা হ্রাস পাচ্ছে।
মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে তেমন ব্যবধান আমি তখন লক্ষ করিনি। দেশের মানুষ অল্পতেই সন্তুষ্ট হন বলে জেনেছি। ফলে ২০০৬ সালের ওই প্রতিবেদনকে আমার যথার্থই বলে মনে হয়েছে। এরপরও এই গবেষণার পদ্ধতিগত ও উপাত্তের গুণগত দিক নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। কিন্তু ১৭ বছর পর সুখ নিয়ে আবার এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবসে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের সেই প্রতিবেদন এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে তালিকা করার ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ৬টি মূল চলকের ওপর ভিত্তি করে শূন্য থেকে ১০ সূচকে নম্বর পরিমাপ করা হয়। সুখী দেশের তালিকার পাশাপাশি প্রতিটি দেশের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি, সামাজিক সহায়তা, জন্মকালে জীবন আয়ুষ্কাল, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা এবং দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নেওয়া হয়।
বলে রাখা ভালো, এটি কোনো সূচক নয়, বরং এই ছয়টি চলক নিয়ে ব্যক্তির অনুভূতি বা মূল্যায়নের মাধ্যমে স্কোর প্রদান। তবে জীবন সম্পর্কে মূল্যায়নগত এ উপাত্তের সঙ্গে ব্যবহৃত ছয়টি চলকের পর্যবেক্ষণজনিত উপাত্তের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা পরিমাপ করা হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত ১৪৩টি দেশের তালিকায় ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯তম অবস্থানে। আর বাংলাদেশের স্কোর হলো ১০-এর মধ্যে ৩.৮৮৬। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১১৮। সে হিসাবে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১১ ধাপ পিছিয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ছিল তালিকার ৯৪ নম্বরে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া সবাই বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে। নেপাল রয়েছে ৯৩তম (৫.১৫৮), পাকিস্তান ১০৮তম (৪.৬৫৭), ভারত ১২৬তম (৪.০৫৪) ও শ্রীলঙ্কা ১২৮তম (৩.৮৯৮), আফগানিস্তান ১৪৩তম অবস্থানে (১.৭২১)। প্রতিবেশী মিয়ানমার আছে ১১৮তম স্থানে (৪.৩৫৪)। এশিয়ার দেশগুলোর ৩০-এর মধ্যে রয়েছে কুয়েত (১৩), আরব আমিরাত (২২), সৌদি আরব (২৮) ও সিঙ্গাপুর (৩০)।
এ তালিকায় নরডিক অঞ্চলের দেশগুলো, বিশেষ করে প্রথম চারটি সুখী দেশের মধ্যে রয়েছে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড ও সুইডেন। এ দেশগুলোর সবার স্কোরই ১০–এর মধ্যে ৭.৩০-এর ওপরে রয়েছে। সাত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে ফিনল্যান্ড।
প্রশ্ন হতে পারে, নরডিক অঞ্চলের দেশগুলো কেন ভালো অবস্থানে রয়েছে আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ কেন ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে? ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?
দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপির হার বেড়েছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, জীবন আয়ুষ্কাল বেড়েছে—তাহলে কেন বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে? তাহলে কি কথিত বা দৃশ্যমান উন্নয়ন মানুষের কি সুখ কেড়ে নিচ্ছে? জীবনের গুণগত উন্নয়ন কি তাহলে হচ্ছে না?
আমি যেহেতু জনবিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করি, ফলে মানুষের বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক সুখ বিভাজন আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে প্রতিবেদনটি আমি আগ্রহসহকারে পড়েছি। বয়স বিবেচনায় তরুণ ও প্রবীণদের পেলেও লিঙ্গ বা জেন্ডারভিত্তিক স্বতন্ত্র বিভাজন ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে নেই।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় বয়স্কদের তুলনায় তরুণ-যুবারা বেশি সুখী। কেন তরুণ-যুবারা (ত্রিশ বছরের নিচে) অপেক্ষাকৃত বেশি সুখী? অধিকতর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ কি সেখানে কোনো বাধা নয়? জীবন নিয়ে তাঁরা সন্তুষ্টই বা কেন?
বাংলাদেশের তরুণ-যুবাদের চেয়ে নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারত অপেক্ষাকৃত বেশি সুখী। তরুণ-যুবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৮। আর এ ক্ষেত্রে স্কোর হলো ৪.২০০। আর ৬০ বছর বয়সী ও ততোধিক ব্যক্তিদের বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। আর স্কোর ৪.১২৪। এটা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে এগিয়ে।
প্রতিবেদনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রবীণেরা তরুণ-যুবাদের তুলনায় অধিকতর সুখী। আর প্রবীণদের মধ্যে উচ্চ-মধ্যবয়সীরা সবচেয়ে কম সুখী।
দেশভিত্তিক নারী-পুরুষ বিভাজন না থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে সব বয়সী মানুষের মধ্যে নারীদের তুলনায় পুরুষেরা কম সুখী। ২০০৬-২০১০ এবং ২০২১-২০২৩–এর মধ্যে সুখের মাত্রাগত পরিবর্তন এসেছে এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১২৪তম আর স্কোর হলো ০.৮৮৭। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ১১৭তম (০.৪৭৯) এবং ভারত ১২৫তম (০.৯২০)।
প্রতিবেদন অনুযায়ী সব বয়সের মানুষের মধ্যে ২০২১-২০২৩ সালে পৃথিবীর সব অঞ্চলেই নারীরা অধিকতর ঋণাত্মক অনুভূতি পোষণ করেছেন। নারী-পুরুষ সব ক্ষেত্রেই পূর্ব-এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো বাদে সব জায়গায়ই ২০০৬-২০১০ সালের চেয়ে ২০২১-২০২৩ সালের ঋণাত্মক অনুভূতি প্রকট হয়েছে।
বিগত দশকের তুলনায় বিশ্বের সব অঞ্চলে ও সব বয়সীদের মধ্যে সুখ-অসমতা ২০ শতাংশের চেয়ে বেশি বেড়েছে। সামাজিক সহায়তা, একাকিত্ব এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সুখের সঙ্গে জড়িত। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি ও একাকিত্ব হ্রাসে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সুখকে প্রভাবিত করে থাকে।
মানুষকে সুখী করার পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতেও থাকতে পারে সুখী হওয়ার উপাদান। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফিনল্যান্ডের মানুষের সুখী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন, সুখ নিয়ে বেশি চিন্তা না করা, হতাশাবাদী না হওয়া, আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা বা বহিঃপ্রকাশ না করে অনাড়ম্বর বা সাদামাটা জীবন যাপন করা।
বর্তমানে আমরা বিশ্বায়িত সমাজ-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর ফলে মূল্যবোধ ও সামাজিক শ্রেয়োবোধে পরিবর্তন আসছে। যৌথ বা বর্ধিত পরিবার আলাদা বা স্বতন্ত্র পরিবারে রূপান্তরিত হচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সম্পর্কের গভীরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। আমরা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গিয়েছি, যা আমাদের আবেগ-অনুভূতিতে প্রভাব ফেলছে। প্রশ্ন উঠেছে, আমরা একমাত্রিক মানুষ হয়ে যাচ্ছি কি না?
২০২৪ সালের বিশ্ব সুখ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘যূথবদ্ধ থাকাতেই সুখ’। অর্থাৎ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে সুখী হওয়া যায়। ফলে বাংলাদেশেও আমরা যূথবদ্ধ থাকতে চাই, কোনো বিভেদ চাই না। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী হতে পারে—সরকার, রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের সবাইকেই তা ভাবতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ