৫২-ফুট লম্বা প্যাপিরাস আবিষ্কার করেছেন মিশরের প্রত্নতাত্ত্বিকরা; যা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অন্তর্গত ‘বুক অফ দ্য ডেডের’ অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। ২,০০০ বছরেরও বেশি পুরানো নথিটি সাক্কারায় জোসারের স্টেপ পিরামিডের দক্ষিণে একটি সৌধের মধ্যে পাওয়া গেছে।
‘দ্য বুক অফ দ্য ডেড’-এ অনেক নতুন তথ্য রয়েছে। নতুন আবিষ্কারটি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার উপর আলোকপাত করতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা। সংরক্ষণের কাজ ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ হয়েছে, এবং প্যাপিরাসটি আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে।
গত ১৪ জানুয়ারী মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দিবস উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশ্যে আনা হয়।
প্রসঙ্গত, আজ থেকে প্রায় ৪,৭০০ বছর পূর্বে এই স্টেপ-পিরামিডের নকশা করেন প্রাচীন মিশরের স্থাপত্য প্রকৌশলী ইমহোতেপ। তিনি মিশরের ফারাওদের চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি সূর্য দেবতা ‘রা’ এর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। তাকে প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থপতি, প্রকৌশলী ও চিকিৎসক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জোসেরের আমলে ফারাওদের মূল সমাধিমন্দির ছিল আবিদোস নামক স্থানে। কারণ, তৎকালীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, আবিদোসে শায়িত আছেন দেবতা ওসাইরিস। কিন্তু প্রথম রাজবংশের রাজাদের সমাধি দাফনের ফলে আবিদোসে তেমন খালি জায়গা অবশিষ্ট ছিল না। তাই, দ্বিতীয় রাজবংশের অনেকে ফারাওই সাক্কারায় নিজ সমাধি নির্মাণ করেন। এছাড়াও, সাক্কারা রাজধানী মেম্ফিসের খুব নিকটে অবস্থিত হওয়ায় ফারাও জোসের সাক্কারাকেই নিজ সমাধিস্থান হিসেবে নির্ধারণ করলেন। সম্পূর্ণ পিরামিড পাথর দ্বারা তৈরি হবে বলে এতে প্রয়োজন ছিল দক্ষ শ্রমিকশ্রেণীর।
কিন্তু যেসকল শ্রমিক জোসেরের স্টেপ-পিরামিড নির্মাণের সাথে যুক্ত ছিল, তাদেরকে দাস বলা যাবে না। কারণ, মিশরে তখনও দাসপ্রথা শুরু হয়নি।
সাম্প্রতিক আবিষ্কার সম্পর্কিত বিবৃতি অনুসারে, সুপ্রিম কাউন্সিল অফ অ্যান্টিকুইটিজের সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা ওয়াজিরি বলেছেন, ১০০বছরেরও বেশি সময় পর সাক্কারাতে এটিই প্রথম পূর্ণ প্যাপিরাস যা উন্মোচিত হয়েছে। জোসারের স্টেপ পিরামিডটি ফারাও জোসারের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ছিল মিশরীয়দের নির্মিত প্রথম পিরামিড।
মিশরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন মন্ত্রী জাহি হাওয়াস একটি ইমেলে লাইভ সায়েন্সকে জানিয়েছেন, স্টেপ পিরামিডের চারপাশের এলাকাটি সহস্রাব্দ ধরে কবর দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। যে কফিনে নতুন প্যাপিরাসগুলি মিলেছে সেগুলি ৭১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দর মধ্যের।
প্যাপিরাসের মালিকানা এবং এর সঠিক তারিখ সম্পর্কে তথ্য শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন হাওয়াস। মিশরীয়রা বিশ্বাস করেন যে ‘দ্য বুক অফ দ্য ডেড হল’ এমন একটি বই যেটি মৃতদের অন্য জগতে প্রবেশের দিক নির্দেশ করে।
৫২ ফুট লম্বা হলেও এর আগে এর থেকেও বেশি দৈর্ঘের বুক অফ দ্য ডেড প্যাপিরির অন্যান্য উদাহরণ রয়েছে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংরক্ষণাগারের প্রধান ফয় স্কাল্ফ একটি ইমেইলে লাইভ সায়েন্সকে জানিয়েছেন, অনেক পান্ডুলিপি আছে যেগুলোর দৈর্ঘ্য একই রকম হতো, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় গ্রন্থের প্যাপিরাসের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হতে পারে।
তবে এটি মূলত দ্বিতীয় প্যাপিরাস, যা গত বছরে সাক্কারাতে পাওয়া গেছে। এটিতে ‘বুক অফ দ্য ডেড’ লেখা হয়েছে। ২০২২ সালে, একটি ১৩-ফুট লম্বা খণ্ডিত প্যাপিরাস যেখানে বুক অফ দ্য ডেড-এর কিছু খণ্ডিত অংশ লেখা রয়েছে তা সাক্কারাতে ফারাও তেটির পিরামিডের কাছে একটি কবরের খাদে পাওয়া গিয়েছিল।
এটিতে “Pwkhaef” নামে এক ব্যক্তির নাম লেখা ছিল। ফারাও তেটির পিরামিডের কাছে সমাধিস্থ হওয়া সত্ত্বেও, পখহেফ বহু শতাব্দী ধরে বেঁচে ছিলেন। কবরের খাদ যেখানে এই প্যাপিরাস পাওয়া গেছে মিশরের ১৮ এবং ১৯ তম রাজবংশের।
একজন প্রাক্তন শাসকের পিরামিডের পাশে সমাধিস্থ করার প্রথা সে সময় মিশরে জনপ্রিয় ছিল। পর্যটন ও পুরাকীর্তি মন্ত্রকের মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল এই আবিষ্কারটি করেছিল, যারা এখনও প্রাচীন নথির ছবি প্রকাশ করতে পারেনি। বিবৃতি অনুযায়ী, নতুন আবিষ্কৃত প্যাপিরাসটি শীঘ্রই একটি মিশরীয় যাদুঘরে প্রদর্শন করা হবে।
বুক অব ডেথ কী?
মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে প্রাচীন মিশরীয়রা বেশ সচেতন ছিল। মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনে কীভাবে চিরস্থায়ী সুখ লাভ করা যায়, তা নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত ছিল না। এজন্য তাদের বিশ্বাসের সুতোয় বাঁধা ছিল প্রাচীন মিশরীয় ধর্মীয় পাঠসমূহ। এসব ধর্মীয় পাঠের মধ্যে ‘বুক অব দ্য ডেড’ বা ‘মৃতের গ্রন্থ’ অন্যতম।
এটি প্রাচীন মিশরীয় রাজবংশের সমাধিসৌধে প্রাপ্ত লিপির সমাবেশ। মৃতদের গ্রন্থ লেখা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫০ অব্দের কাছাকাছি সময় থেকে (নতুন সাম্রাজ্যের উত্থান কাল) খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ অব্দ পর্যন্ত। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ অব্দের দিকে পঞ্চম রাজবংশের ফারাও ইউনাসের পিরামিডে সর্বপ্রথম পিরামিড পাঠ ব্যবহার করা হয়েছিল।
লিপিসমূহের মূল মিশরীয় নাম হচ্ছে ‘rw nw prt m hrw’, যে অনুবাদের প্রায় কাছাকাছি অর্থ হচ্ছে ‘Book of coming forth by day’ (আগত দিনের গ্রন্থ) এবং ‘Book of emerging forth into the light’ (জ্যোতির পানে উদীয়মান যাত্রার গ্রন্থ)। এই লিপিগুলো দিয়ে সরাসরি গ্রন্থ বোঝাচ্ছে, সেটাও নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। ‘গ্রন্থ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে লিপিগুলোর সবচেয়ে কাছাকাছি অনুবাদ হিসেবে।
শুরুর দিকে শুধুমাত্র রাজ পরিবারের ব্যক্তিবর্গের মৃতদেহের সাথেই মৃতের গ্রন্থ দিয়ে দেওয়ার রীতি চালু ছিল। সে প্রথা বিলুপ্ত করে সপ্তদশ রাজবংশের সময়ে রাজকীয় সভাসদ ও কর্মচারীদের মৃতদেহের সাথেও বুক অভ দ্য ডেড দেওয়া হতো। থেবসে দ্বিতীয় মধ্যবর্তীকালীন রাজবংশের সময়ে (খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের কাছাকাছি) মৃতের গ্রন্থের রেওয়াজ শুরু হয়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যে ফারাওয়ের সমাধিতে সর্বপ্রথম মৃতের গ্রন্থ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি হলেন ত্রয়োদশ রাজবংশের রানি মেন্টুহোতেপ। অবশ্য সে কফিনে ‘বুক অভ দ্য ডেড’ এর পাশাপাশি পুরনো পিরামিড কফিনের পাঠসমূহও ছিল।
এসডব্লিউএসএস/১১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ