লুজাইন আল-হাথলুলক নামে এক মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রখ্যাত নারী অধিকারকর্মীকে জঙ্গিমূলক আচরণের অভিযোগে পাঁচ বছর আটমাসের কারাদণ্ড দিয়েছে সৌদি প্রশাসন। গতকাল সোমবার (২৮ ডিসেম্বর) সৌদির সন্ত্রাসবাদ আদালত এ রায় দেন। গাড়ি চালানোর অপরাধে লুজাইনকে ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। আন্তর্জাতীক বিভিন্ন মানবধিকার সংস্থার চাপ উপেক্ষা করে সৌদি সরকার তাকে এই কারাদণ্ড দেয়।
লুজাইন দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের নারীদের অধিকার আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। একই সাথে সৌদি শাসনে পুরুষের কর্তৃত্ববাদ নিয়েও বিভিন্ন আন্দোলন করেছেন। এবং নারীদের বিভিন্ন অধিকার নিয়েও ছিল তার সরব উপস্থিতি। সৌদি আরবে তখন নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল। লুজাইন গাড়ি চালিয়ে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এরপর সে সহ একাধিক নারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয় সৌদি সরকার। লৌজাইনকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে জঙ্গিমূলক আচরণের মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ, আন্তর্জাতিক সহায়তায় দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন তিনি।
হাথলুলের বোন লিনা দাবি করেন তার বোন সন্ত্রাসী নয়। সে একজন নারী অধিকার কর্মী। সৌদি প্রশাসন উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে কারাদণ্ড দিয়েছে।
লুজাইন আল-হাথলুল প্রথম খবরে উঠে আসেন ২০১৪ সালে৷ গাড়ি চালিয়ে সৌদি আরব থেকে আরব আামিরাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তিনি৷ সেই সময় সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানো বিষয়ে ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা৷
এরপর ২০১৮ সালের মে মাসে গ্রেফতার হন তিনি৷ তার সঙ্গে তখন আরো বেশ কয়েকজন নারীকেও গ্রেফতার করা হয়।
লুজাইনকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলো সরব ছিল। শুধু এনজিও নয়, জার্মানি সহ একাধিক দেশ কূটনৈতিকভাবে লুজাইনের মুক্তি দাবি করে। মুক্তি না দিলে সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়। কিন্তু সৌদি সরকার এসমস্ত আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে এই রায় দেন।
অনেকেই মনে করেন এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সৌদি সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। কেননা সদ্য নির্বাচিত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিভিন্ন সময়ে সৌদি আরবের মানবধিকার নিয়ে সমালোচনা করে আসছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, লুজাইনকে কারাদণ্ডাদেশ এই দুই দেশের মধ্যকার পুরনো সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে। শুধু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো থেকেও আকার ইঙ্গিতে তেমনিই আভাস দিয়ে আসছিল। এমনকি লুজাইনকে দণ্ডাদেশ দেওয়ার পরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ লুজাইনের মুক্তির জন্য সোচ্চার বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
৩১ বছর বয়সী লুজাইনকে ২০১৮ সাল থেকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এ জন্য দুই বছর ১০ মাসের সাজা মওকুফ করেছেন আদালত। দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকা লুজাইনকে মুক্তি দিতে নানা সময় আহ্বান জানিয়ে আসছে মার্কিন কংগ্রেস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনপ্রণেতারা। বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ তুলেছে যে, লুজাইনকে কারাগারে নানাভাবে যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। একই অভিযোগ তুলে তাকে মুক্তি দিতে সৌদি সরকাররের কাছে বার বার অনুরোধ জানিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি তার পরিবার।
মূলত সৌদির রাজপরিবারের শাসন ব্যবস্থা এবং প্রভাবশালী যুবরাজ সালমানের বিরুদ্ধে কথা বলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে কারাগারে পাঠানো হয়। সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থা রদবদল এবং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষতি করার মতো গুরুতর অভিযোগে লুজাইনকে এই কারাদণ্ড দেওয়া হলেও বিভিন্ন মানধিকার সংস্থা এই অভিযোগকে উদ্দেশ্য প্রণীত মনে করে আসছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা লুজাইনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে ভুয়া বলে অভিহিত করেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ইতিমধ্যেই তার মুক্তির জন্য দরবার শুরু করেছে।
এদিকে লৌজেইনের আন্দোলনের পরে সৌদিতে দীর্ঘদিনের আইন বদলানো হয়। নারীদেরও গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়া হয়। ফুটবল মাঠে বসে খেলা দেখার অধিকার—এরপর সরাসরি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়। তাই সঙ্গত কারণেই বিভিন্ন মানবধিকার সংস্থা ও লুজাইনের পরিবার দাবি করেন, সৌদি সরকার উদ্দেশ্য জনিত কারণে এই রায় দিয়েছে। আবার অনেকে বলেন, সৌদি রাজ পরিবারের দিকে আঙ্গুল তোলার অপরাধে সৌদি সরকার কখনোই আপোষ করেনি, এবারও তাই।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ