২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সুযোগটি আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই নিয়েছিল। দেশের পরিস্থিতি যা-ই হোক, ভোটার ভোটকেন্দ্রে আসুক বা না আসুক, যেকোনো উপায়ে একটা নির্বাচন করিয়ে নিতে পারলে দ্বিতীয় মেয়াদে তাদের ক্ষমতায় থাকাটা জায়েজ হয়ে যাবে। এর ফল আমরা দেখলাম, ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগ বা তাদের সমর্থিত প্রার্থীরা ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হয়ে গেলেন। এটি নিয়ে অনেকেই গাঁইগুঁই করল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানালেন। পরে বুঝতে পারলেন, এ নিয়ে বেশি কথাবার্তা বলার মানে হয় না।
২০১৮ সালে হলো আরেকটি নির্বাচন। বড় দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না এলে নির্বাচন সাংবিধানিক বৈধতা পেলেও মানুষ এটা ভালোভাবে নেয় না। তারা মুখটিপে হাসে। তো আওয়ামী লীগ সরকার ভাবল, এবার বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেই হবে এবং আওয়ামী লীগকে তৃতীয় মেয়াদে সরকারে থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার কথা দিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে গণভবনে প্রায় সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হলো। ‘সংলাপ’ তখন টক অব দ্য টাউন। তত দিনে বিরোধীদের একটা ঐক্যজোট হয়ে গেছে। তার নেতা ড. কামাল হোসেন, মূল শক্তি বিএনপি। গণভবনে ড. কামালের পছন্দের চিজ কেক খাওয়ানো হলো। প্রধানমন্ত্রী বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ দেখালেন। বিএনপির কেউ কেউ বললেন, সরকারের ফাঁদে পা দেওয়া ঠিক হবে না। কেউ কেউ বললেন, ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের কৌশল ছিল ভুল। কিন্তু এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আরেকটি ভুল।
বিএনপি নির্বাচনে গেল, কিন্তু ঘটে গেল অভাবনীয় একটি ব্যাপার। বিএনপি ও তার মিত্ররা ছয় থেকে সাতটি আসন পেল। বলা যায়, তাদের ছয় থেকে সাতজনকে বিভিন্ন জায়গা থেকে জিতিয়ে আনা হলো। তখন একটা কথা চাউর হলো—রাতের ভোট। বিএনপি স্বপ্নেও ভাবেনি, এ রকম একটি অ্যান্টিক্লাইমেক্স অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। দেশের মানুষও ভাবেনি।
২০২৩ সালের শেষ বা ২০২৪ সালের শুরুতে হবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। বিএনপি এখন ২০১৪ সালের দাবিতে ফিরে গেছে। নতুন কিছু শব্দ রাজনৈতিক ভোকাবুলারিতে ঢুকে গেছে—নির্বাচনকালীন সরকার, জাতীয় সরকার ইত্যাদি।
পরপর দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই রকম কৌশল নিয়ে নির্বাচনে পার পেয়ে যায়। এটা নিশ্চয়ই তাদের অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশ হবে। সে জন্য চাই বিপুল আয়োজন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের ধারাবাহিকতা আছে বলেই উন্নয়ন হচ্ছে। যারা উন্নয়ন চায় না, কেবল তারাই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে। ইঙ্গিতটি খুব স্পষ্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায়।
গত দুটি নির্বাচনে নির্বাচনব্যবস্থার বারোটা বেজে গেছে। প্রশ্ন হলো, পরবর্তী নির্বাচনটি কেমন হবে। তার চেয়েও বড় প্রশ্ন—২০১৪ আর ২০১৮ তো গেল। এবার আওয়ামী লীগ কী কৌশল নেবে? পুরোনো কৌশলের তো পুনরাবৃত্তি হবে না। আর এই সব কৌশলের ভীরে গণতন্ত্র কি শ্বাস নিতে পারবে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের কৌশল নির্ধারণ করতে ব্যস্ত রয়েছে। সরকারি দল-আওয়ামী লীগ- ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যদিও দলটির সাম্প্রতিক সম্মেলন নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞই।
রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের মূল হাতিয়ার হচ্ছে জনগণের আস্থা অর্জন করা। যে রাজনৈতিক দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে তারাই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে জনগণের সামনে পরিবর্তনের একটি রূপরেখা তুলে ধরতে হয়। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে দেখেছে। সমস্যার সমাধান দেখেনি।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলীয় ঐক্য ও শান্তির আওয়াজ যত তীব্র হোক না কেন, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মোহাম্মদ আবু হেনা সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেটা অর্থহীন হবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ বোধ করে। যদিও বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের কারণে গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ কমেছে। এবার আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে হবে না, গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আগামী নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে দলের ঐক্য ও সংহতির ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু দলের ঐক্য ও সংহতি যে এখনো ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক সম্মেলনে দলীয় সভানেত্রীর বক্তৃতার প্রতিই সবার আগ্রহ ছিল। তিনি আগামী নির্বাচন, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে কী নতুন দিকনির্দেশনা দেন, তা–ই ছিল সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। কিন্তু দেখা গেল, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে যাওয়ার প্রত্যয় ছাড়া তার ভাষণে নতুন কিছু ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন না হওয়ার পক্ষে বড় যুক্তি হলো আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা।
কিন্তু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচন নিয়ে দেশে যে একটা সমস্যা চলছে, সেটি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে স্বীকার করতে হবে। অস্বীকারের সংস্কৃতি কী ভয়াবহ বিপদ আনতে পারে, অতীতে আমরা একাধিকবার দেখেছি।
আওয়ামী লীগের দাবি, বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। বিএনপি ও এর সহযোগীদের কথা হলো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলীয় ঐক্য ও শান্তির আওয়াজ যত তীব্র হোক না কেন, রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত নেই। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মোহাম্মদ আবু হেনা সম্প্রতি বলেছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে সেটা অর্থহীন হবে। আওয়ামী লীগকে কেবল নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে হবে না, গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘‘এখনো অনেক সময় বাকি আছে৷ রাজনীতি প্রতিদিন সাংঘাতিকভাবে পরিবর্তিত হয়৷ কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল বিএনপি নেই, বিএনপি নেই৷ গত তিনমাস পর এখন দেখা যাচ্ছে বিএনপি আছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘এখন থেকে অনুমান করা কঠিন৷ তবে আমার কাছে মনে হয়, ২০১৪-এর মত হবে না৷ অ্যামেরিকার ইন্টারেস্ট বাংলাদেশের উপর অনেক বেশি৷ পুরো ওয়েস্ট, এবং স্যাংশন সবকিছু মিলিয়ে… আমার বিশ্বাস একটা নেগোশিয়েসন প্রসেস শুরু হবে জানুয়ারি মাসে৷ যেখানে আওয়ামী লীগও, যেহেতু আওয়ামী লীগ ইজ অ্যা পলিটিক্যাল পার্টি৷ যে যতই বলুক না কেন, সবচেয়ে পুরোনো পলিটিক্যাল পার্টি, আওয়ামী লীগও একটু ছাড়ের জায়গায় আসবে৷
তিনি বলেন ‘‘ঐ ছাড়ের উপর ভিত্তি করে তখন বিএনপি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো, তারাও এটাকে কনসিডার করবে, নির্বাচনে যাওয়ার দিকে৷’’
তবে তিনি আশঙ্কা করে বলেন ‘‘এই নেগোশিয়েন ফেইল করলে, ঐ ইলেকশন করাটা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে না৷’’
এ বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘‘এখন এটাকে প্রেডিক্ট করা কঠিন৷ তারপরও সহজে যেটা বুঝি যে, দেশি বিদেশি কূটনৈতিক ও অন্য মহলদের যে তৎপরতা, এমনকি দেশের মধ্যে যারা এমনকি লুটপাটকারীরা তারাও, তাদের সো কল্ড একটা স্থিতিশীলতা চাইবে৷ এইজন্য তারা চেষ্টা করবে, যে এই দ্বি-দলীয় ধারায় যাতে থাকে এবং তার মধ্যে একটা সমঝোতা করে যদি হয়…৷ ’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সেটা যদি না হয়, বাংলাদেশে তো আমরা আরো নানা ধরনের ঘটনা দেখেছি৷ অরাজনৈতিক ঘটনা, নানা বিষয়গুলো আছে৷ কোনো সম্ভাবনাকেই এখন উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷’’
এসডব্লিউএসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ