দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে তা একটা প্রকট পরিণতি পায় নাইন ইলেভেনের ঘটনার মধ্য দিয়ে। নাইন ইলেভেনে টুইট টাওয়ারে হামলার মধ্য দিয়ে আমেরিকার রাজনীতি বুঝতে পারে যে, তাদের দেশ আর বহির্শত্রুর হাত থেকে নিরাপদ নয়। পাশাপাশি বিশ্বের ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিযোগিতায়
থাকা অন্য দেশগুলোও বুঝতে পারে আমেরিকারও শেষ আছে। বলা যায়, নাইন ইলেভেনের মধ্য দিয়েই আমেরিকার পতনের সূচনা হয়, যা গত বিশ বছর ধরে আফগানিস্তানে পরিণতি পেয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়েছিল দ্বিমেরুবিশিষ্ট বিশ্বরাজনীতি। একদিকে ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে এককেন্দ্রিক করে তোলে। সেই বৃত্তের কেন্দ্রে ছিল শুধুই যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক বছরে সেই বৃত্তে আলাদা প্রভাব বলয় সৃষ্টি করেছে চীন ও রাশিয়া। বৈশ্বিক একের পর এক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে যেখানে ব্যর্থ হতে দেখা যায়, সেখানে চীন ও রাশিয়া ছিল অনেক এগিয়ে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল অনেক দেশই এখন চীন ও রাশিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা আর ওয়াশিংটনের ওপর ভরসা করতে পারছে না। তারা মনে হয় এতদিনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্যের সারমর্ম বুঝতে পেরেছে। কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া মারাত্মক।’ মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া প্যাসিফিকের যেখানেই যুক্তরাষ্ট্র সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। বিপর্যয় থেকে বাঁচতে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাতারাতি বাস্তুচ্যুত হয়ে ইউরোপমুখী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতার খাতিরে ইউরোপকে এই শরণার্থীদের আশ্রয়ও দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে কার্যত যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের কোনো দায়িত্বই নেয়নি। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিকবার ইউরোপকে হুমকি দিয়েছিলেন ন্যাটো থেকে হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে যাওয়ার। ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, ন্যাটোতে বার্ষিক যে খরচ হয় তার সিংহভাগ যুক্তরাষ্ট্রকে দিতে হয়, কিন্তু ব্যয় অপেক্ষা তেমন সুবিধা যুক্তরাষ্ট্র পায় না। ট্রাম্পের ওই বক্তব্য ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের জটিলতাকে সামনে নিয়ে আসে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের মতো ইউরোপকে হুমকি না দিলেও কূটনৈতিক পর্যায়ে তিনিও ইউরোপের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। আর এই সুযোগ নিচ্ছে রাশিয়া। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ভালো। রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া যে ইউরোপের চলবে না, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ভালো করেই জানেন। ফলে ট্রাম্প যখন ইরান চুক্তি থেকে বের হয়ে আসেন, তখন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া দাওয়াই অনুসরণ করেই ইউরোপীয় নেতাদের ইরানের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে দেখা যায়।
গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র যখন এশিয়া প্যাসিফিকে দমনাভিযান চালাতে ব্যস্ত ছিল, চীন তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ই অঞ্চল ছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের যত শত্রু দেশ, তারা মিত্র হতে থাকে চীনের। ২০০৮ সালে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্রেফ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে অস্থিরতা শুরু হয়, তা-ই মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার রাস্তা করে দেয়। ওবামার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের ধনী ব্যবসায়ীরা ও আড়ালে থাকা নীতিনির্ধারকরা এটা বুঝতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি নতুন করে যুদ্ধের ফ্রন্ট খোলে তাহলে দেশে বেকারত্বের হার যেমন বাড়বে, তেমনি সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে; যা সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে যাবে। ফলে রাজনীতিতে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও ডোনাল্ড ট্রাম্পই হন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি চেয়ারে বসার পর থেকেই একের পর এক চুক্তি থেকে সরে আসা, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব উসকে দেওয়া, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক, অভিবাসন সমস্যার চূড়ান্ত আকার দেন। ট্রাম্পের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে আমেরিকার স্থানীয় জনগণ লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রের বছরের পর বছর ধরে লালন পালন করা পররাষ্ট্রনীতির।
ট্রাম্পের ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে বসার পর ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেনের খুব বেশি কিছু করার ছিল না। বিশ্ব মঞ্চে যে দিন দিন কমছে বিশ্ব শাসন করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, তা সম্প্রতি এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে। দেশটির বয়োজ্যষ্ঠ গোষ্ঠীর ৪৭ শতাংশই এটি মনে করছেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
তবে সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৩২ শতাংশ মনে করছেন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আগের মতোই আছে। ১৯ শতাংশ মনে করছেন তাদের ক্ষমতায়ন কমেনি বরং বেড়েছে।
জরিপ করা হয় ১৯টি দেশের মধ্যে। যেখানে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই ভিন্নপথে হেঁটেছে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিজের দেশের প্রভাব বিশ্বে দুর্বল বলে মনে করছেন। সুইডেন, নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠরা মনে করছেন তাদের দেশের বৈশ্বিক প্রভাব প্রায় একই রয়ে গেছে।
ভিন্নপথে আছে ইসরাইলও। যেখানে দেশটির বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্করা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের দেশের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই মতামতের সঙ্গে যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্পর্ক আছে তাও উঠে এসেছে সমীক্ষায়।
৬৩ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান এবং রিপাবলিকানপন্থি স্বতন্ত্ররা বলছেন, বৈশ্বিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দুর্বল হচ্ছে। একই চিন্তা লালন করা ডেমোক্রেটপন্থির সংখ্যা মাত্র ৩৭ শতাংশ। শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রেই এমন তা নয়, বরং সব দেশের লোকরাই রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে খানিকটা প্রভাবিত।
জরিপ করা প্রায় প্রতিটি দেশে, যারা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না তারা সমর্থকদের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করে যে, বিশ্বে তাদের দেশের প্রভাব দুর্বল হচ্ছে।
সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৩টি দেশে, যারা ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন করে না তাদের দেশের প্রভাব দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা সমর্থকদের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ বেশি। পার্থক্যটি গ্রিসে সবচেয়ে বেশি। যেখানে প্রায় অর্ধেক (৪৭%) যারা শাসক দল, নিউ ডেমোক্রেসিকে সমর্থন করে না। তারা মনে করছে বিশ্বে গ্রিসের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ছে।
যেখানে নিউ ডেমোক্রেসি সমর্থকদের মধ্যে শুধু ৬% একই ধারণা লালন করছে। পার্থক্য সংখ্যার ব্যবধানে ৪১। গ্রিস ছাড়াও হাঙ্গেরি, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে শাসক দলের সমর্থক এবং অসমর্থকদের সংখ্যায় প্রায় ২০ বা তার বেশি পার্থক্য রয়েছে।
যেসব দেশের নাগরিকরা বিশ্বাস করেন তাদের দেশের দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে-প্রভাব হ্রাস পাওয়ার ঘটনায় তাদের উত্তরই নেতিবাচক। জরিপকৃত প্রায় অর্ধেক দেশের উত্তরদাতারাই মনে করছেন, তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শক্তিশালী দ্বন্দ্ব আছে। এবং তার মনে করছে বিশ্বে তাদের দেশের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। যেমন যুক্তরাজ্য। যারা দলীয় গোষ্ঠীর মধ্যে গুরুতর সংঘর্ষ দেখছেন। তাদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ বলেছেন যে, তাদের দেশ হেরে যাচ্ছে।
যারা রাজনৈতিক পার্থক্য দেখেন না তাদের মাত্র ৩০% শতাংশ প্রভাব কমার ধারণায় একমত। ইসরাইল এখানেও এর বিপরীত অবস্থান ধরে রেখেছে। যারা শক্তিশালী দলীয় দ্বন্দ্ব দেখেন তারাও মনে করছেন তাদের দেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখছে।
যে দেশের মানুষ তাদের গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় তারাও বলতে পারে তাদের দেশের বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া দেশগুলো তাদের শিশুদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরও সমীক্ষায় উঠে আসে। প্রতিটি দেশের নাগরিকরাই মনে করছেন তাদের সন্তানদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটবে।
এসডব্লিউএসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ