ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীসহ ৩ জনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
সোমবার (৫ ডিসেম্বর) ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন এই আদেশ দেন। পরোয়ানা জারি হওয়া অপর দুই আসামি হলেন খন্দকার এনামুল হক ও কাজী রেজাউল হক।
এদিন মামলাটির চার্জগঠন শুনানির দিন ধার্য ছিল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিনজন আদালতে হাজির ছিলেন। রিজভীসহ তিনজন হাজির না থাকায় আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। একইসঙ্গে আগামী ২৯ মার্চ চার্গঠন শুনানির দিন ধার্য করেন।
জানা যায়, ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কাকরাইলের বিজয় নগরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে ২০০/২৫০ জন লাঠিসোটা নিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গাড়িচালক আয়নাল বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন।
মামমলাটি তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন পল্টন থানার উপপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন খান। মামলার অপর আসামিরা হলেন জামায়াত নেতা মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম মাসুদ, আজিজুল বারী হেলাল, সাইফুল ইসলাম নিরব, শফিউল বারী বাবু ও মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে বাবু। আসামিদের মধ্যে শফিউল বারী বাবু মারা গেছেন।
উল্লেখ্য, অপরাধ দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকায় পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে এ বিশেষ অভিযানে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে ঘরছাড়া হচ্ছেন তারা। বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, মেস ও বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে ব্লক রেইড দিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে সারা দেশে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া পুলিশের বিশেষ অভিযানে রোববার পর্যন্ত (চার দিনে) এক হাজার ৩১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় দুই হাজার ২২৬টি অভিযান চালানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার সমাবেশ ঘিরে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও ভাঙচুরসহ যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে নগরবাসীর জানমাল রক্ষায় তারা অভিযান শুরু করেছেন। বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান ও শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতাও নজরদারিতে রয়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ ঠেকাতে ইতোমধ্যেই তাদের নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার শুরু করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশ হানা দিচ্ছে। দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও আটকের প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল দুপুরে দাবি করেছেন, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মোট গ্রেপ্তার ৩০ নভেম্বর রাত থেকে ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টা পর্যন্ত ৭৮৩ (অন্তত পক্ষে) জন। ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টা থেকে রবিবার ৪ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত ২৪৮ (অন্তত পক্ষে) জন। গত ৩০ নভেম্বর রাত থেকে রবিবার ৪ ডিসেম্বর দুপুর পর্যন্ত (৪ দিনে) ১০৩১ (অন্তত পক্ষে) জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রাজধানীজুড়ে ব্লক রেইড প্রসঙ্গে পুলিশের দাবি-ওয়ারেন্টের আসামি, মাদক বিক্রেতা, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের ধরতে এ অভিযান চলছে। এ অভিযান চলতে থাকবে সামনের দিনগুলোতেও। এটিকে রুটিন ওয়ার্ক দাবি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেছেন, ‘কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, কেবল যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, তাদেরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজধানীবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের যা যা করণীয়, সবই করবে বলেও উল্লেখ করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের বাড়ির সামনে তল্লাশি চৌকি বসানোর বিষয়ে ডিসি ফারুক বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবনের সামনে বাড়তি যে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, তা আমাদের নিয়মিত ডিউটির অংশ। সেখানে অতিরিক্ত কোনো কিছুই নয়, মূলত সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় ফোর্স মোতায়েন করেছি।
গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরের অপারেশন শাখার পাঠানো এক আদেশ অনুসারে, দেশের সব পুলিশ ইউনিটের প্রধান ও সব জেলার পুলিশ সুপারদের ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালাতে বলা হয়েছে। আদেশে বলা হয়, অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি আবাসিক হোটেল, মেস, হোস্টেল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারসহ অপরাধীদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পরিচালিত অভিযানে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী ও কারবারি, অবৈধ অস্ত্রধারী, পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার, মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।
এরপর গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই রাজধানীসহ সারাদশে শুরু হয় পুলিশি অ্যাকশন। ঢাকার গত দুই দিন ধরে ব্লক রেইড শুরু করে পুলিশ। চিহ্নিত অপরাধীদের পাশাপাশি হানা দেয়া হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসা বাড়িতে। বিশেষ করে ১০ ডিসেম্বরকে বিএনপির সমাবেশকে কেন্ত্র করে নাশকতা কিংবা অরাজকতায় নেতৃত্ব কিংবা জড়িত হতে পারে বিএনপি-জামায়াতের এমন নেতাকর্মীদের বাসায় হানা দিচ্ছে পুলিশ। গত এক মাস ধরে তথ্য প্রযুক্তি, স্থানীয় সোর্স ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় অভিযানের জন্য আগেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয় মাঠ পুলিশের হাতে। তবে অভিযানে গিয়ে বেশিরভাগ ঠিকানাতেই বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পুলিশ পাচ্ছে না। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে নাশকতার একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোনায়ানা রয়েছে, তাদের সবাই পলাতক রয়েছেন। রাজধানীর বাইরে বিভাগীয় শহর ও বড় জেলা শহরগুলোতে একইভাবে পুলিশ অভিযান চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, গতকাল রাতেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযানের নামে পুলিশ। এতে থানা পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরাও অংশ নেন। এর আগে শনিবার রাতে বনানীর কাকলি এলাকায় কয়েকটি আবাসিক হোটেলে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী সন্দেহে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। হোটেলগুলোতে জঙ্গিরা অবস্থান করছে-এমন খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া পল্টন এলাকা ও মতিঝিলের দৈনিক বাংলা মোড়ে হোটেল রহমানীয়াতে ও তেজগাঁও এলাকায় পুলিশের বিশেষ অভিযান বা ব্লক রেইড হয় বলে জানিয়েছেন মতিঝিল বিভাগের ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান।
ডিএমপির ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ সামনে রেখে বিএনপি ও জামায়াতের ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের হালনাগাদ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। পুরনো রাজনৈতিক মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। গত চারদিন ধরেই অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে শনিবার রাত থেকে গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার করা হয়। বিশেষ করে নাশকতার মামলার আসামি ও জামিনে ছাড়া পাওয়া বিএনপি-জামায়াতের ‘হিটার’ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। নেতাকর্মীরা হোটেল কিংবা মেসে অবস্থান নিতে পারে, ফলে এসব জায়গায় অভিযানের আওতায় আনা হচ্ছে।
বিএনপির সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে কলাবাগান থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইয়াসিন, ধানমণ্ডি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পলাশ, লালবাগ থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আফতাব ইয়াকিনকে ডিবি গ্রেপ্তার করেছে। ওয়ারী থানাধীন ৪১ নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য আমিনুল ইসলাম নয়ন, বংশাল থানা বিএনপি নেতা মো. নাদের ও কোতোয়ালি থানাধীন ৩২নং ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আলাউদ্দীন আলাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন, পশ্চিম মানিকদি ইউনিট বিএনপির সভাপতি ইব্রাহিম হক, ক্যান্টনমেন্ট থানা বিএনপি নেতা জুয়েল মাস্টার, আবদুল হান্নান, আহমেদ আলী, পল্লবী থানা বিএনপি নেতা শাকিল আল হাসান, ভাটারা থানা বিএনপি নেতা মেহেদী হাসান সোহেল, হাসান, শফিকুল ইসলাম, ফয়সাল, আলমাস, সোহেল, মোহাম্মদ জাকির ও কামাল গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া দক্ষিণখান থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি শাহাবুদ্দিন সাগর, বিমানবন্দর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি জুলহাস পারভেজ মোল্লা, কাফরুল থানা বিএনপি নেতা মো. হেলাল উদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) ডিআইজি এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে এটি পুলিশের একধরনের রুটিন ওয়ার্ক। তিনি বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনাক্রমে বিজয়ের মাসে রাজধানীতে বøক রেইড শুরু হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, আমরা তাদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি। কাউকে হয়রানি করার জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে না। তবে বাস্তবতা বলছে অন্য কথা।
এসডব্লিউএসএস/১১৩৫
আপনার মতামত জানানঃ