একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ২০০২ সালে লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ডের ঘটনাটি সবচেয়ে চমকপ্রদ। তার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদে সময় ‘সন্তানের ভরণপোষণ’ এর জন্য কোর্টে আবেদন করেন। এই আবেদনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই ডিএনএ টেস্ট করানো। রিপোর্টে দেখা যায়, তার ২ সন্তানের কারো সাথেই তার ডিএনএ মিলছে না! স্বাভাবিকভাবেই কোর্টে তিনি নকল মা সেজে স্বার্থোদ্ধারের জন্য প্রতারক হিসেবে সাব্যস্ত হন। তার আইনজীবী কোর্টের সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করার অনুরোধ করেন, যত দিন পর্যন্ত লিডিয়ার তৃতীয় সন্তান জন্ম না নেয়। কোর্ট একজন স্বাক্ষী উপস্থিত থাকবে সন্তান জন্মদানের সময় এই শর্তে আবেদন মঞ্জুর করেন। তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়, এবং তার সাথেও ডিএনএ মেলেনি লিডিয়ার।
তখনই তার আইনজীবী ধারণা করেন, লিডিয়ার কাইমেরা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আদালতের নির্দেশে পুনরায় ডিএনএ টেস্টে লিডিয়ার শরীরে আরেক সেট ডিএনএ খুঁজে পাওয়া গেলো। ঐ একই ধরনের ডিএনএ সেট লিডিয়া মায়ের শরীরে পাওয়া যায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় লিডিয়া একজন কাইমেরা। বেকসুর খালাস হয় তার এবং তার সন্তানদেরও ফিরিয়ে দেয়া হয়।
এবার চলুন কাইমেরিজম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক। কী, কেন, কীভাবে হয় বা কী কী বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
কাইমেরিজম কী?
কাইমেরিক মানুষের শরীরে একজনের নয় বরং দুজন বা ততোধিক মানুষের বৈশিষ্ট্য থাকে। অর্থাৎ এ ধরনের মানুষের শরীরে এক ধরনের নয়, দুই বা ততোধিক ধরনের ডিএনএ থাকে। তার মানে, একক দেহ ও স্বত্তার অধিকারী একজন কাইমেরিক ব্যক্তি আসলে একজন না, তার মধ্যে দুজন বা তার বেশি মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে। কি, অদ্ভুত লাগছে না শুনতে? এটা কি আদৌ সম্ভব! হ্যাঁ, সম্ভব। শুধু গাছ বা ফুল না, মানুষের মধ্যেও রয়েছে কাইমেরিক বিশিষ্ট্য।
কাইমেরিজম হলো মানবদেহের এমন বিশেষ অবস্থা যেখানে একজনের দেহে একের অধিক রকমের জিনোটাইপ বা জিন দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ সাধারণত প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ডিএনএ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে এবং একজন মানুষের মধ্যে এক ধরণের ডিএনএ-ই থাকে। তবে কাইমেরিক ব্যক্তির দেহে একের অধিক ধরণের ডিএনএর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত কাইমেরা নামক দৈত্যের নামের সাথে মিল রেখে এর নামকরণ করা হয়। কাইমেরা হলো এক পশু যে একটি সত্ত্বা হলেও তার মধ্যে রয়েছে তিনটি আলাদা অস্তিত্ব। এর এক মাথা সিংহের মতো আরেক মাথা ছাগলের মতো। এর লেজের অগ্রভাগে রয়েছে সাপের মাথা। অর্থাৎ একের মধ্যে অধিক। পৌরাণিক কাহিনীর এই দৈত্যের চরিত্রের সাথে কাইমেরিজমের বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে বলে এর এরুপ নামকরণ করা হয়।
কীভাবে সম্ভব?
মূলত নন-আইডেন্টিকাল জমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার একদম শুরুর দিকে যখন ভ্রুণ তৈরি হয় তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে জরায়ুতে। দুইটি (বা ততোধিক) ভ্রুণ সৃষ্টি হলেও এর মধ্যে একটি (বা একাধিক) ভ্রুণের বিকাশ হতে পারে না। তাই সেই ভ্রুণটি (ভ্রুণগুলো) অন্য ভ্রুণের ভেতরে ঢুকে যায় বা কিছু অংশ জরায়ুর সাথে এবং কিছু টিস্যু আরেক ভ্রুণের সাথে মিশে যায়।
এর ফলে মায়ের জরায়ুতে শুরুতে একাধিক ভ্রুণের সৃষ্টি হলেও পরবর্তিতে একটি শিশু জন্মায় যার মধ্যে দুই বা ততোধিক জিনোটাইপ রয়েছে। এভাবেই কাইমেরিক বাচ্চার জন্ম হয়। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি যে, কাইমেরিক ব্যক্তি নিজের সাথে নিজের জমজ ভাই কিংবা বোনের ছায়া নিয়ে ঘুরছে।
কিভাবে জানবেন আপনি কাইমেরিক?
ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে কাইমেরিক ব্যাক্তির মধ্যে দুই বা ততোধিক ডিএনএ পাওয়া যায়। কিন্তু এই মাল্টিপল ডিএনএগুলোর অবস্থান শরীরে কেমন করে থাকে এবং এর অস্তিত্বই বা কিভাবে প্রকাশ পায়!
সাধারণত কাইমেরিক ব্যক্তিরা নিজেদের শরীরের এই অন্যরকম বৈশিষ্ট্যটির ব্যাপারে হঠাৎ করেই জানতে পারে। হয়তো কোন মেডিকেল টেস্টের মাধ্যমে অথবা চিকিৎসা নিতে গিয়ে তাদের কাছে ব্যাপারটি ধরা পরে।
একজন কাইমেরিক ব্যক্তির শরীরের কিছু অংশে এক ধরণের ও বাকি অংশে অন্য ধরণের ডিএনএর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেমন মুখের লালায় ‘ক’ টাইপের ডিএনএ এবং জনন কোষে পাওয়া যাবে ‘খ’ টাইপের ডিএনএ। এমন বাস্তব উদাহরণ পাওয়া গিয়েছে।
তাছাড়াও অনেকসময় বাহ্যিকভাবে অর্থাৎ শুধু দেখেই বলে দেয়া যায় যে কে কাইমেরিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঘুরছে। এমন ব্যক্তিদের সাধারণত দুই চোখের রঙ আলাদা হয় বা চুলের কিছু অংশ অন্য রঙের হয়।
জরায়ুতে কাইমেরিজমের ঘটনাটি কেন ঘটে?
সাধারণত বিভিন্ন জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, IVF এবং সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ নারীদের জরায়ুর উর্বরতা বাড়াতে যে ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয় এসবের কারণে গর্ভাবস্থায় কাইমেরিজমের ঘটনাটি ঘটে থাকে। ট্রান্সজেন্ডারদের জন্মও কাইমেরিজমের ফলে হয়ে থাকে।
বিভিন্ন ধরনের কাইমেরিজম
টুইন কাইমেরিজম
ভ্রুণ অবস্থায় মায়ের শরীরে জমজ ভ্রুণের একটি ভ্রুণ অনেক সময় মারা যায়। এবং বেঁচে থাকা ভ্রুণটি মৃত ভ্রূণটিকে নিজের মধ্যে শোষণ (Absorb) করে নেয়। ফলে জন্ম নেওয়া মানুষটির শরীরে তার নিজের ও তার নিজের জন্ম না নেওয়া ভাই/বোনের, মোট দুই সেট ডিএনএ থাকে।
টেট্রাগ্যামেটিক কাইমেরিজম
মাতৃ গর্ভাশয়ে সাধারণত একটি শুক্রাণু দ্বারা একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট তৈরি হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে দুটি শুক্রাণু দুটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার পর একত্রিত হয়ে একটিমাত্র ভ্রুণে পরিণত হলেও এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। জন্ম নেওয়া শিশুর শরীরে তখন দুই সেট ডিএনএ পাওয়া যায়।
মাইক্রো কাইমেরিজম
গর্ভবতী অবস্থায় মা তার ভ্রুণের কিছু কোষ শোষণ করে নিতে পারে কিংবা উল্টোভাবে ভ্রুণটি মায়ের কিছু কোষ শোষণ করে নিতে পারে। এই কোষগুলো মা কিংবা শিশুর রক্তের মাধ্যমে কোনো অঙ্গে পৌঁছে স্থায়ীভাবে থেকে যায়।
কৃত্রিম কাইমেরিজম
ব্লাড ট্রান্সফিউশন, স্টেম সেল প্রতিস্থাপন কিংবা বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও কোনো ব্যক্তির দেহে অন্য ব্যক্তির কিছু কোষ থেকে যেতে পারে। ফলে একজনের দেহে দুই সেট ডিএনএ দেখা যায়। যদিও বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এ ধরনের ঘটনা কম দেখা যায়। এ ধরনের কাইমেরিজমে শুধু রক্তে দু’ধরনের ডিএনএ সেট দেখা যায়। কিন্তু অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না।
এসডব্লিউএসএস/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ