উদ্যোক্তা হিসেবে এলোন মাস্কের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। এখনও পর্যন্ত সবার কাছে পরিচিত তার দুটি উদ্যোগ হলো—টেসলা ও স্পেসএক্স। এগুলোর পাশাপাশি তিনি আরও একটি ভিন্নধর্মী প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছেন। এর মধ্যে একটি প্রকল্পের নাম নিউরালিংক।
ভারতীয় প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম গেজেটস নাউ জানায়, নিউরালিংক হলো এমন একটি প্রকল্প, যার মাধ্যমে মানুষের ব্রেইনে কম্পিউটার চিপ লাগিয়ে দেওয়া হবে। এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে ব্রেইন আরও জটিল সব কাজ দ্রুতগতিতে করতে পারবে।
সূত্র মতে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে মানবদেহে নিউরালিংককের ওয়্যারলেস ব্রেইন চিপ পরীক্ষার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেছেন ইলোন মাস্ক। এর আগে একবার সময় নির্ধারণ করে দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষা চালাতে পারেনি।
কী কী সুবিধা পাবে মানুষ?
বেশ কিছুকাল ধরেই মাস্কের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি ব্রেইন চিপের উন্নয়নে কাজ করে আসছে। তাদের দাবি চিপটি শারীরিকভাবে অক্ষম রোগীদের চলাচল ও যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করবে। সম্প্রতি মাস্ক জানান, চিপটি দৃষ্টিশক্তি ফেরাতেও সহায়তা করবে।
তবে ইলন মাস্কের দাবি আরও বিস্তৃত। ভবিষ্যতে নতুন কোনো ভাষা শেখার ক্ষেত্রে কিংবা কোনো দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে নিউরালিংক ডিভাইস মুহূর্তে তা মস্তিষ্কে আপলোড করে দেবে। এমনকি ব্রেইনকে কপি করা সম্ভব হবে বলেও আশাবাদী মাস্ক।
নিউরালিংক ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস (বিএমআই) বা ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। এ ধরনের প্রযুক্তিতে মানব মস্তিষ্কের সঙ্গে সরাসরি কম্পিউটারের সংযোগ করে দেয়া হয়। ফলে শুধু মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করা সম্ভব।
নতুন এ চিপের বিষয়ে সর্বশেষ দেয়া এক আপডেটে ইলোন মাস্ক জানান, মানবদেহে প্রতিস্থাপনের আগে চিপটির শতভাগ কার্যকারিতা নিশ্চিতে আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি। নিউরালিংককের সদর দপ্তরে ৩ ঘণ্টাব্যাপী আয়োজিত প্রেজেন্টেশনে অতিথিদের সামনে মাস্ক ডিভাইসের উন্নয়ন নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পদক্ষেপের বিষয়ে জানান।
মাস্ক জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে দুজন মানুষের ওপর নিউরালিংকক ডিভাইসের পরীক্ষা চালানো হবে। বিশেষ করে যাদের দৃষ্টিশক্তি নেই বা দুর্বল ও চলাচলে অক্ষম। তিনি বলেন, যদি জন্মের সময় কেউ দৃষ্টিশক্তি ছাড়া জন্মায় আমাদের বিশ্বাস তাদেরও আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারব।
এক বছরেরও বেশি সময় আগে নিউরালিংকক তাদের একটি পরীক্ষা প্রকাশ করেছিল। যেখানে দেখা যায়, ব্রেইন চিপযুক্ত একটি বাদর একাই কম্পিউটার গেম খেলছিল। সে সময় এটি ব্যাপক সাড়া ফেলে।
উল্লেখ্য, বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টেসলা, রকেট ফার্ম স্পেসএক্স ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার পরিচালনা ছাড়াও মাস্কের আরো কিছু পরিকল্পনায় রয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলগ্রহে উপনিবেশ তৈরি করার মাধ্যমে মানবজাতিকে রক্ষা করা অন্যতম। ২০১৬ সালে নিউরালিংকক চালু করাও এর অন্তর্গত ছিল।
বিশ্বের অন্যতম ধনী ইলোন মাস্কের লক্ষ্য এমন একটি চিপ তৈরি করা, যেটি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্রেন থেকেই জটিল বৈদ্যুতিক ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এছাড়া এটি প্যারালাইজড হওয়া রোগীদের পুনরায় চলাচলে সহায়তা করবে এবং পারকিনসনস, ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারের মতো রোগ নির্মূল করবে।
অন্যদিকে নিউরালিংকক এখনো নির্ধারিত সময়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ২০১৯ সালে দেয়া এক প্রেজেন্টেশনে মাস্ক জানিয়েছিলেন, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ তিনি নিয়ন্ত্রকদের অনুমতি পাবেন। ২০২১ সালের শেষ দিকে এক সম্মেলনে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে চলতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে মানবদেহে চিপের পরীক্ষা চালানো হবে।
নিউরালিংককের সাবেক ও বর্তমান কর্মীরা জানান, মানবদেহে পরীক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকবার এফডিএর অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়েছে। আগস্টে রয়টার্স প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের শুরুতে বিনিয়োগের বিষয়ে মাস্ক প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান সিংক্রনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
মূলত নিউরালিংককের কর্মীদের ধীর কার্যক্রমে বিরক্ত হয়েই এ পথে এগিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে সিংক্রোন প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের এক রোগীর শরীরে ডিভাইস যুক্ত করে নতুন মাইলফলক তৈরি করেছে।
এটি মস্তিষ্কের ভেতরে বসানো থাকবে এবং বাইরে ডাটা পাঠাবে। তিনটি চিপ মস্তিষ্কের মোটর অঞ্চলে এবং একটি সোমাটোসেন্সর এরিয়ায় রোপণ করতে চান প্রযুক্তিটির উদ্ভাবকরা। প্রতিটি চিপ ৫-৪ ন্যানোমিটার, যা মানুষের চুল থেকে পাতলা। এটি প্রতি সেকেন্ডে ২০ হাজার ব্রেন স্যাম্পল রিড করতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা চিপটিকে মস্তিষ্কের ভেতরে বসানোর জন্য নিউরোসার্জিক্যাল রোবট তৈরি করেছেন। এই রোবটের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে ছয়টি চিপ মাথায় সার্জারি করে বসানো যাবে। তবে সার্জারি করার সময় রক্তনালি এড়িয়ে যাওয়া হবে। ফলে মস্তিষ্কে প্রদাহজনিত সমস্যা কম হবে।
গবেষকরা সার্জারিটি চোখের ল্যাসিক সার্জারির মতো জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই করতে চান। এই চিপ নিউরনের অ্যানালগ ডাটা পড়তে পারবে এবং বেতারের মাধ্যমে কানের পাশে থাকা ডিভাইসটির ডিজিটাল ডাটা পাঠাবে।
ডিভাইসটি আইফোনের একটি অ্যাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এর বড় সুবিধা—এটি তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে না এবং একসঙ্গে অনেক ডাটা ট্রান্সফার করতে পারবে। নিউরনের ক্রিয়াকলাপও রেকর্ড করতে পারবে। প্রযুক্তিটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। এখনো প্রযুক্তিটি গবেষণাগারে বিড়ালের ওপর গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে।
বিতর্কিত বিষয়গুলো
নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে মানুষকে। মানুষের অজান্তেই বদলে দেয়া যেতে পারে পছন্দ অপছন্দ। এমনকি ভালোলাগা ভালোবাসার কোনকিছুকে। কিংবা হয়তো স্মৃতিও মুছে দেওয়া যেতে পারে। আর এই চিপ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়, তাহলে যন্ত্রচালিত একটা মানুষ কতটা ভয়ংকর হতে পারে আমরা হয়তো ধারণাও করতে পারবো না। তবে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে, আমাদের চারপাশে মানুষ চালিত যন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে।-অনেক বিশেষজ্ঞেরই ধারণা এমনটা।
এছাড়া, মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। কোন মানুষের মস্তিষ্ক ঠিক কতটা আল্ট্রাসাউন্ড এবং অন্যান্য যান্ত্রিক চাপগুলো নিতে পারবে, তা দেখার প্রয়োজন আছে।
কারণ, মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা আছে। বাড়তি চাপ প্রয়োগের ফলে এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মস্তিষ্ক নিজস্বতা হারিয়ে ফেলতে পারে। মস্তিষ্কের নিজস্ব একটি পরিচালনা ব্যবস্থা আছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ মস্তিষ্ককে তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহার করা শুরু করেছে।
এরপর যদি কম্পিউটার-ব্রেইন ইন্টারফেস ব্যবহার করা হয়, তাহলে একটা সময় আমাদের মস্তিষ্ক এর নিজস্ব কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে।
তবে এমনটা যে হবেই, তা নয়। হতেই পারে যে, আর দশটা যন্ত্রের মতোই এই যন্ত্রটিও মানুষের কার্যক্ষমতাকেই বাড়িয়ে দেবে শুধু। বিজ্ঞানীরাও তা-ই ভাবছেন। খুব ভালো কিছু পাওয়ার জন্য খানিকটা ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক তারা।
এসডব্লিউএসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ