গণতন্ত্র কিন্তু প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পিছু হটছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত বা গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা। বস্তুতঃ স্ক্যানডেনেভিয়ান কয়েকটি দেশ ছাড়া আর কেউই নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত বলে দাবি করতে পারে না। এক সময় যে যুক্তরাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের বাতিঘর বলা হতো, সেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সে দেশের গণতন্ত্রের বড় পরীক্ষা হবে। তবে এ পরীক্ষায় যেই জিতুক, আগামী দশকে বেশ কয়েকটি কারণে বিশ্বের উপর ছড়ি ঘোরাবে চীন। চলুন এর মধ্যে কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
পারমাণবিক অস্ত্র
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুতের সংখ্যা তিন গুণের বেশি বেড়ে প্রায় দেড় হাজারে দাঁড়াতে পারে। মঙ্গলবার প্রকাশিত পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে চীনের বিমানবাহিনীর শক্তিমত্তা বাড়ছে বলে দাবি করা হয় বলে সিএনএন জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী চীনের কাছে মজুত থাকা পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বাড়ানোর এই গতি অব্যাহত রাখলে ২০৩৫ সাল নাগাদ তা প্রায় দেড় হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে।
এএফপি বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে বেইজিং। বর্তমানে দুই দেশের প্রত্যেকের কাছে কয়েক হাজার করে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র মজুত রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকায়নের কাজ করছে চীন। দেশটি ২০২১ সালে প্রায় ১৩৫টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। পেন্টাগনের মূল্যায়ন হলো, চীনের বিমানবাহিনীর দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। তারা দ্রুত পশ্চিমা বিমানবাহিনীগুলোর সক্ষমতার পর্যায়ে চলে আসছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, চীনের বিমানবাহিনী সব ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতির চেষ্টা করছে। সরঞ্জামের উন্নয়নের পাশাপাশি তারা পাইলটসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতা বাড়াচ্ছে।
চীন অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈমানিককেও চাকরি দিয়ে নিজেদের বিমান বাহিনীর বৈমানিককে পশ্চিমা দেশগুলোর বিমান হামলা কিভাবে ঠেকাতে হবে সে কৌশল শেখাচ্ছে এমন খবর প্রকাশ হয়ে গেলে হৈ চৈ শুরু হয়।
এরপর এক অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন বৈমানিককে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠায় যিনি চীনা পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রভাবশালী
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন এগিয়ে আছে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের সেন্টার ফর ফিউচার অব ডেমোক্রেসির এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬২ শতাংশ মানুষই চীনকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে বিশ্বে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছে ৬১ শতাংশ মানুষ। খবর নিউজউইকের।
দুই দেশের মধ্যে ভোটের পার্থক্য মাত্র এক শতাংশ। তবে এই ক্ষুদ্র পার্থক্যকে সামান্য ভাবতে নারাজ বিশ্লেষকরা। বরং বিষয়টিকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বে বাড়তে থাকা মেরুকরণের দিকেই ইঙ্গিত করছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে পশ্চিমা গণতন্ত্র। এই ভাবধারায় চীন ও রাশিয়াকে বরাবরই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তবে বিগত ১০ বছরে পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার অনেক দেশই চীন ও রাশিয়ামুখো হয়ে উঠেছে।
সেন্টার অব ডেমোক্রেসি বিশ্বের প্রায় ৯৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী বসবাসকারী ১৩৭টি দেশে পরিচালিত ৩০টি বৈশ্বিক জরিপের সমন্বয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায় মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসবাসকারী অপেক্ষাকৃত উন্নত বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের বিরুদ্ধে ও ৮৭ শতাংশ মানুষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভাব পোষণ করে।
তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশ চীনের প্রতি ও ৬৬ শতাংশ রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। গত ১০ বছরে রাশিয়া ও বিশেষত চীন বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর দেশগুলোর প্রতি উন্নয়নশীল বিশ্ব আরও ঝুঁকেছে।
চীনা মুদ্রা ইউয়ানের আধিপত্য
চায়না সংবাদমাধ্যম ইয়াহু নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতি অধিকাংশ সূচক অনুসারেই বেশ শক্তিশালী। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১৭.৭ ট্রিলিয়ন ডলার যা যুক্তরাষ্ট্রের পরেই বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরে চীনই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক লেনদেনকারী দেশ।
তবে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক লেনদেনের মাত্র ৩ শতাংশ চীনা মুদ্রায় হয়, যেখানে মার্কিন ডলারে মোট লেনদেনের ৮৭ শতাংশ হয়ে থাকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশটি বৈশ্বিক মুদ্রা প্রবাহে তেমন একটা অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, ধীরে ধীরে ইউয়ানের অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।
চীনা ইউয়ান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার ডি-ফ্যাক্টো রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়া চীনের মুখাপেক্ষী হয়। বর্তমানে রাশিয়ার ১৭ শতাংশ ফরেন রিজার্ভই ইউয়ানে। মস্কো এক্সচেঞ্জেও ইউয়ান এখন তৃতীয় চাহিদাসম্পন্ন মুদ্রা।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালোফোর্নিয়া বার্কলে-র ব্যারি আইচেনগ্রিন এবং ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যামিলে ম্যাকায়ারের মতো অর্থনীতিবিদরা রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকরা বলেন, ডলারকে খুব সহজে বা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে না। তবে তারা দেখতে পান যে, চীনের সঙ্গে যেসব দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হচ্ছে তাদের রিজার্ভ মুদ্রায় ইউয়ানের ব্যবহার বাড়ছে।
‘বহুমেরু’-বিশিষ্ট এক বিশ্বে ইউয়ানের বাড়তে থাকা প্রভাব বিশ্বব্যাপী একে ডলারের বিকল্প করে তুলতে পারে। অন্যভাবে বললে, চীন ধীরে ধীরে ডলারের প্রভাব কমিয়ে আনতে পারে।
গবেষকরা আরও বলেন, ১৯৫০-এর দশকে ডলারের যে অবস্থান ছিল, বর্তমানে ইউয়ান সেই অবস্থানে রয়েছে। সেই হিসেবে ডলারের জায়গায় উঠে আসা- ইউয়ানের জন্য আর কয়েক দশকের ব্যাপার মাত্র। ভবিষ্যদ্বাণী অনু্সরণ করলে, দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীরা ভালো মুনাফা আসা চীনা শেয়ার ও অন্যান্য ইউয়াননির্ভর খাতে সীমিত হলেও বিনিয়োগ করতে পারেন।
অতএব এটা অনুমান করতে খুব কষ্ট হবার কথা নয় যে, আগামী দশকেই ডলারের কাঁধে নিশ্বাস ফেলবে ইউয়ান। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ইউয়ানকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চীনকে দু’টি কাজ করতেই হবে। প্রথমত, ডলারের প্রতি দুনিয়াজুড়ে যে আস্থা তা নষ্ট করতে হবে। এটি তখনই সম্ভব, যখন ফেডারেল রিজার্ভ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হবে। কিংবা যখন এ বিষয়ক পূর্বাভাসগুলো ভুল প্রমাণিত হবে।
চীনকে দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে, তা হলো ইউয়ানের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রমাণ করা। না হয় অন্যান্য দেশের আস্থা অর্জন অসম্ভব। কিন্তু এ স্থিতিশীলতার পথে চীনের সমস্যা চীন নিজেই। সে মাঝে মধ্যেই রফতানি বাড়াতে ইউয়ানের অবমূল্যায়ন করে। অন্য দেশগুলো কখনোই এমন অস্থিতিশীল মুদ্রা রিজার্ভ হিসেবে রাখবে না। চীন যদি এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হতে পারে, বদলে যাবে বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা।
এসডব্লিউএসএস/১৯১০
আপনার মতামত জানানঃ