দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য পরিস্থিতি একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে দেশের বর্তমান সংকট তৈরি হয়নি। অনেকগুলো ঘটনা মিলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতির আগে থেকেই কিছুটা সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। কোভিডের ধাক্কা পরিস্থিতিকে কিছুটা জটিল করে তুলেছিল।
এরপর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব রিজার্ভ-সংকট ও ডলারের দাম বৃদ্ধি সংকটকে আরও তীব্রতর করল। কোভিডের সময় দেশের দরিদ্র মানুষেরা সহায়–সম্বল বিক্রি করে চলেছে। এরপর খাদ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল।
এই পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের নেই। এমনকি, মধ্যবিত্তরাও এখন সংকটে পড়েছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা অতিদরিদ্র মানুষের, তারা সারা দিনে এক বেলা খাবার জোগাড় করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে। তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। একমাত্র উচ্চবিত্তরা ভালো আছে।
কোভিডের আগে থেকেই দেশে আয়বৈষম্য বাড়ছিল। কোভিডের কারণে ওই বৈষম্য আরও তীব্র হয়। এর আগেও আমরা দেখেছি যেকোনো সংকটে দেশে বৈষম্য বাড়ে। কোভিড এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ওই বৈষম্য আরও বাড়বে। দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এখন যে খাদ্য ও জীবিকার সংকটে আছে, তারা সরকারি সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না।
ফলে এখন সরকারের দায়িত্ব, তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। কারণ, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের বড় অংশ তাদের আয়ের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খাদ্য বাবদ ব্যয় করে। দরিদ্ররা আয়ের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। এখন খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই দরিদ্র শ্রেণি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে।
এদিকে, সরকারি সংস্থাগুলো তো বলছে দেশে খাবারের কোনো সংকট নেই, বিশেষ করে চালের। তবে সরকারি তথ্য যদি আমরা বিবেচনায় নিই, মানে পরিসংখ্যান ব্যুরো চাল উৎপাদনের যে তথ্য দিচ্ছে, তা আমলে নিলে দেশে চালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু বাস্তবতা তো তা বলছে না। কারণ, হয় খাদ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে, অথবা মাথাপিছু খাদ্যের ভোগ কমিয়ে দেখানো হচ্ছে।
সরকারি তথ্যে যে গলদ আছে, তার প্রমাণ হচ্ছে একদিকে বলা হচ্ছে দেশে খাদ্যের চাহিদার চেয়ে বেশি আছে। অন্যদিকে দেশে চাল সরকারি-বেসরকারি দুই খাতেই আমদানি করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি আমরা অনেক দিন ধরে দেখছি। এভাবে তো একটি দেশ চলতে পারে না। কারণ, দেশে খাদ্যঘাটতি থাকলে এক ধরনের কৌশল নিতে হবে, ঘাটতি না থাকলে আরেক ধরনের কৌশল।
এদিকে, সরকার দেশের ভেতর থেকে চাল কেনার চেয়ে বিদেশ থেকে আমদানিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশ ও বিদেশ থেকে চাল আমদানির ক্ষেত্রে দুই ধরনের সমস্যা আমরা দেখি। দেশের ভেতরে চালের বাজার গুটি কয় চালকলমালিক ও বড় ধান ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের ইচ্ছায় চালের দাম ওঠানামা করে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
এমনকি সরকারি চাল সংগ্রহের সফলতা নির্ভর করে ওই গোষ্ঠীর ওপর। আবার বিদেশ থেকে বেশি দামে চাল ও গম কেনার মতো ঘটনা ঘটতে দেখছি। ওই চাল-গম ভর্তুকি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট দামে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে বণ্টন করা হচ্ছে। বেশি দামে খাবার কিনলে তার জন্য সরকারকে বেশি বেশি ডলার ভর্তুকি দিতে হবে। এই সংকটকালে তা জটিলতাকে আরও বাড়াবে।
কারণ দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে ডলারের দাম ও রিজার্ভ কমে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, আমাদের প্রকৃত রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার। জরুরি কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজন যাতে মেটানো যায়, সে জন্য রিজার্ভ থাকে। এ অবস্থায় আসার কারণ হলো, আমরা একটা সত্য-মিথ্যার ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দী হয়ে ছিলাম। আমরা এমন একটা মনোভাব দেখিয়েছি, আমাদের রিজার্ভ যেন অফুরন্ত। ফলে রিজার্ভ থেকে আমরা এখানে-সেখানে দিয়ে দিয়েছি।
মেগা প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রেও একই ধরনের মনোভাব কাজ করেছে। আমরা আমাদের প্রকৃত সামর্থ্যটা মূল্যায়ন করে দেখিনি। আমরা আশা-দুরাশার দোলাচলে ঢুকে এমন বিভ্রান্ত হয়ে গেছি যে প্রকল্পগুলোতে যে টাকা ব্যয় করার দরকার, তার থেকে অনেক বেশি ব্যয় করে ফেলেছি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রোল মডেল হওয়ার চিন্তাটা আমাদের এত বেশি মোহাচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে আমরা প্রকৃত বাস্তবতাটা ভুলে গেছি। আমরা যদি প্রকৃতপক্ষে একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করতাম, যেখানে সত্য বলার পরিসর থাকত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতিটা এ রকম হতো না। গণতন্ত্রহীনতার কারণেই এমনটা ঘটেছে। মাঠপর্যায় থেকে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী
এদিকে, আইএমএফ ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ কয়েক কিস্তিতে দেবে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এই ঋণ বৈদেশিক বাণিজ্য ও রিজার্ভের ক্ষেত্রে বর্তমান যে টানাপোড়েন, সেটা কিছুটা লাঘব হবে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্বস্তি এলে এর ইতিবাচক প্রভাব কৃষি ও খাদ্য খাতেও পড়বে। তবে এই প্রভাব পড়তে সময় লাগবে।
আইএমএফের ঋণের কিছু শর্ত আছে। প্রথম কিস্তি দেওয়ার পর শর্তগুলো কতটা পূরণ হলো, তার ওপর নির্ভর করে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় করবে। আইএমএফের কাছ থেকে সদস্যদেশ হিসেবে যে কেউ ঋণ নিতে পারে। সেটা অধিকারও। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে শর্তগুলো আমাদের জন্য ভালো কি মন্দ, সেটা প্রধানভাবে বিবেচ্য।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৩৫
আপনার মতামত জানানঃ