আফগানিস্তানের তালেবানরা নারীর বিরুদ্ধে যে কঠোর বৈষম্যমূলক আচরণ করে, তা সবারই জানা। এমনকি এদেশে মুখে নারীর নাম উচ্চারণ করাও নিষেধ। সরকারী বিভিন্ন নথিপত্রে পিতার নাম নথিভুক্ত করার নিয়ম থাকলেও মায়েরা থেকে যান জীবনের আড়ালে। সেখানে নারীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠ দমনে তালেবান সরকার সরব থাকাটাই সেটাই স্বাভাবিক। আফগানিস্তানে এখন সমানে সহিংস ঘটনা ঘটছে। পরিকল্পনা করে হত্যা করা হচ্ছে একের পর এক ব্যক্তিত্বকে। সেই তালিকায় যোগ হলো এবার আরেকটি নাম। গত বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) আফগানিস্তানে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার ফ্রেশতা কোহিস্তানি নামের এক নারী অধিকারকর্মীকে গুলি করে হত্যা করে তালেবান সরকার।
জানা যায়, প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিলের সাবেক সদস্য কোহিস্তানি নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতেন। ২৯ বছর বয়সী কোহিস্তানির কোনো ভয়ডর ছিল না। সাহসী এই নারী ছিলেন সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনের অতি পরিচিত মুখ। তিনি সামাজিক মাধ্যমে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। এ নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাবুলে অনেকগুলি সভা করেছেন। এর আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আবদুল্লাহের হয়ে প্রচারও করেছিলেন। বৃহস্পতিবার মোটরবাইকে চেপে ফ্রেশতার সামনে হাজির হয় অজ্ঞাত দুষ্কৃতীরা। তাকে লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। মৃত্যু হয় ফ্রেশতার। গুলিবিদ্ধ হন তার এক ভাইও। জখম অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারও মৃত্যু হয়।
কয়েকদিন আগেই ফেসবুকে তাঁকে হুমকি দেয়া হচ্ছিল বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তিনি নিরাপত্তা রক্ষী চেয়েছিলেন। গত নভেম্বরে সামাজিক মাধ্যমে তিনি লিখেছিলেন, ”আফগানিস্তানে আর শান্তিতে বসবাস করার মতো জায়গা নেই। দর্জিকে বলে রাখুন, শেষকৃত্যের পোশাকের মাপ নিয়ে রাখতে। কাল আপনার পালা আসতে পারে।”
এরপরই ঘটে তার হত্যাকাণ্ড। আফগান সরকার এবং তালেবানের মধ্যে শান্তি বৈঠক চলাকালীন সম্প্রতি সে দেশে রাজনীতিক, সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীদের উপর হামলা এবং খুনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গেছে। পরিকল্পনা করে হত্যা করা হচ্ছে একের পর এক ব্যক্তিত্বকে। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন নারী অধিকারকর্মী ফ্রেশতা কোহিস্তানি।
নারীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা বহু নারী অধিকারকর্মীকেই তালেবান সরকার হত্যা করে চলেছে। সেটারই ধারাবাহিকতার শিকার ফ্রেশতা। তালেবান সরকারের বন্দুকের সামনে জোরালো কণ্ঠ নিয়ে যারাই দাঁড়াচ্ছে বন্দুকের গুলিতে তাদের প্রাণ বধে সরকারের দ্বিতীয়বার ভাবতে হয় না। আর যখন সেই ব্যক্তিটি হয় নারী এবং তার উদ্দেশ্য হয় নারী অধিকার রক্ষা তখন তালেবান সরকার আরো ভয়ানক রুপ নেয়।
এর আগে চলতি মাসেই মালালাই মাইওয়ান্ড নামের এক সাংবাদিক ও নারী অধিকারকর্মী তালেবান সরকারের হাতে খুন হয়। কাজে যাবার জন্য বাসা থেকে বের হবার অল্প সময়ের মধ্যেই বন্দুকধারীরা তার গাড়িকে তাক করে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়৷ সেখানেই প্রাণ হারান মাইওয়ান্ড ও তার গাড়ির চালক।
এবছরে তালেবান সরকারের বন্দুকের টার্গেট হোন ৪৫ বছর বয়সী ফাউজিয়া কুফি নামে একজন প্রখ্যাত নারী অধিকারকর্মী। পার্শ্ববর্তী পারওয়ান প্রদেশ থেকে ফাওজিয়া যখন কাবুলে ফিরছিলেন তখন অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা রাজধানীর কাছে একটি বাজার এলাকায় তার গাড়ির ওপর হামলা করে। এতে গুলিবিদ্ধ হন ফাওজিয়া।
এই তালিকায় রয়েছে আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আরো বহু নারী অধিকারকর্মী। এবং তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নারী অধিকারকর্মীদের পাশাপাশি যেসব নারী তালেবান সরকারের কট্টর নিয়মের বাইরে এসেছেন, তারাও সরকারের বুলেটের আওতায় এসেছেন। নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সবরকম চেষ্টার মুখেই দাঁড়িয়ে থাকে জঙ্গিবাদ পোষণকারী এই সরকার। অনেকেই মনে করেন, আফগানিস্তান থেকে তালেবান সরকারের অপসারণ না হলে নারী অধিকারকর্মী হত্যার তালিকা এবং নারীদের নির্যাতন নিপীড়ণমূলক ঘটনা দিনদিন আরো জটিল হয়ে যাবে। কেবল নারী অধিকারকর্মী বা নারী নয়, তাদের পাশে হত্যাকাণ্ডের তালিকায় রয়েছে বহু বিশিষ্ট মানুষ। গত বুধবার(২৩ ডিসেম্বর) কাবুলে প্রকাশ্য দিনের আলোয় অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন মহম্মদ ইউসুফ রশিদ নামের এক ব্যক্তি। নির্বাচনী দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্তকারী একটি সংগঠন চালাতেন তিনি। এ সপ্তাহেই গজনিতে মসজিদে নমাজ পড়তে যাওয়ার সময় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন রহমাতুল্লা নেকজাদ নামের এক সাংবাদিক।
আপনার মতামত জানানঃ