একজন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের খুব কাছাকাছি। আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে হাঙ্গেরি স্টাইলের ‘প্রতিযোগিতামূলক কতৃর্ত্ববাদ’ দেখা যেতে পারে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এমনভাবে জালিয়াতি হতে পারে যে—ডেমোক্র্যাটরা জিততে পারবে না। দ্য গার্ডিয়ানের ঐ সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, মার্কিন গণতন্ত্রের ভাঙন হতে পারে রক্তপাতহীন, নীরব এবং আরো বেশি অত্যাধুনিক ও জটিলভাবে।
জাতিসংঘ বলেছে, শক্তিশালী ও কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেশি কাজ করতে হবে। অধিকারবঞ্চিত সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার ও ন্যায়বিচারসহ অন্যান্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে সবকিছুই ঢেলে সাজাতে হবে। এএফপি ও পলিটিকো। যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায়ই ‘গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর’ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিসট্যান্স’র (আইআইডিইএ) এক রিপোর্টে প্রথমবারের মতো ‘ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্র’র দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নাম। গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এবারের (২০২০) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সেই নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। যা মার্কিন ইতিহাসে বিরল। এ ছাড়া জনগণের বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মতপ্রকাশ তথা বাকস্বাধীনতা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে দেশটির সরকার ও প্রশাসন। সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদাসীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
সংস্থাটির সংখ্যালঘু অধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফারনান্দ ডা ভ্যারেনেস জানান, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার আইনি কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে দেশটির কয়েক রাজ্যের গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপ গণতন্ত্রকে অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মধ্যবর্তী নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
গতকাল শুক্রবার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে ওবামার। সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে জর্জিয়ায় এক নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নেন তিনি। এ সময় নির্বাচনে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতায় বসা ঠেকাতে সবাইকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান ওবামা।
জর্জিয়ার আটলান্টা শহরতলিতে এই জনসমাবেশে জোর গলায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘শুধু ডেমোক্র্যাট সদস্যদের নির্বাচিত করলেই হবে না; আমাদের ভালো মানুষকে নির্বাচিত করতে হবে।
পরবর্তী নির্বাচনে দেখা যাবে, এমন সব মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যারা একসময় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। আর তাঁরা যদি জয় পান, তাহলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা আমার জানা নেই।’
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা। এর পর থেকে তিনি নিজেকে অনেকটা আড়াল করে ফেলেন। জর্জিয়ায় ডেমোক্র্যাটদের প্রচারণা অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
আগামী মাসের নির্বাচনে এই অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
জর্জিয়ার বর্তমান সিনেটর ডেমোক্র্যাট সদস্য রাফায়েল ওয়ারনক পদ ধরে রাখতে লড়ছেন রিপাবলিকান সদস্য হার্শেল ওয়াকারের বিরুদ্ধে। অঙ্গরাজ্যটির প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সিনেটর ওয়ারনক। আর সাবেক ফুটবল তারকা ওয়াকারের পেছনে সমর্থন রয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
এই দুজনের জয়-পরাজয়ের ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কোন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সিনেটের নিয়ন্ত্রণ হারালে বাধার মুখে পড়তে পারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিভিন্ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
জর্জিয়ার পরবর্তী গভর্নর কে হচ্ছেন, তা নিয়েও তুমুল লড়াই হতে পারে। এই লড়াইয়ে রিপাবলিকান পার্টির ব্রায়ান কেম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সদস্য স্টেসি আব্রামস।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই কক্ষ কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নির্ধারণ করতে ইতিমধ্যে ভোট দেওয়া শুরু করেছেন মার্কিনরা। দেশজুড়ে গভর্নর নির্বাচনের ভোটাভুটিও শুরু হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে আরও কয়েকশ’ পদে কারা ক্ষমতায় আসছেন, তা জানা যাবে আগামী ৮ তারিখ।
প্রসঙ্গত, ১৭৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র এখন গভীর বিপদে। দেশে ও বিদেশে খুব আলগাভাবে পরস্পর সম্পৃক্ত কয়েকটি ঘটনা বর্তমান এ সংকটের জন্য দায়ী।
বিদেশে চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একটি দমনমূলক শাসনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের ভেতরের যে শত্রু, তারাই গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এখন কট্টর ডানপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি সুপ্রিম কোর্টে এই চরমপন্থীদের জন্য জায়গা করে দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে চরমপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কি যোগ্যতার প্রদর্শন করলেন? ১৯৭৩ সালের ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার মাইলফলক রায়ে নারীরা গর্ভপাতের যে অধিকার পেয়ে আসছিলেন, সেটা বাতিল করে দিলেন। অবশ্য এটাই তাদের যোগ্যতার একমাত্র প্রমাণ নয়! তারা তাদের সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা দিতে গিয়ে যে যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং সেই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যতটা নিচে নেমেছেন, সেটাও তাদের বড় যোগ্যতা।
বিচারপতি স্যামুয়েল অ্যালিটো গর্ভপাতের অধিকার বাতিল করে দেওয়ার যে রায় সেটার বেশির ভাগ অংশের মতামত লিখেছেন। এই বিচারপতি দাবি করেছেন, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী কেবল সেই সব অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয়, যেগুলো ১৮৬৮ সালে এটি অনুমোদনের সময় বিদ্যমান ছিল। তার এই যুক্তি ১৮৬৮ সালে চতুর্দশ সংশোধনী অনুমোদনের পর যেসব অধিকার নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা ভোগ করে আসছে, তার সব কটিকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
এই যুক্তি ধরে এখন রাষ্ট্র আন্তবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধ করে দিতে পারবে। ১৯৬৭ সালের আগে এ ধরনের বিবাহ নিষিদ্ধ করতে পারত রাষ্ট্র। আবার এ রায়ে এটা স্পষ্ট, আদালত নির্বাহী বিভাগের ওপর সরাসরি আঘাত করতে চায়। সম্প্রতি এর সবচেয়ে বড় নজির হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গঠিত অতি দরকারি কর্তৃপক্ষ এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির স্বীকৃতি দিতে রাজি হননি সুপ্রিম কোর্ট।
অবশ্য এই আইন যদি শুধু কারা ভোট দিতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করতেও প্রণয়ন করা হতো, সেটাও যথেষ্ট খারাপ একটা ঘটনা হতো। কিন্তু রিপাবলিকানরা এখন ভোট গণনা ও নির্বাচন–সত্যায়নের ব্যবস্থার ওপরও আঘাত করেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সহজে ধ্বংস করে ফেলার জন্য আইনের পরিবর্তন ঘটাতে সেই ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁরা ট্রাম্পের সেই খোলা মিথ্যা কথায় (২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল চুরি করে নেওয়া হয়েছে) বিশ্বাস করেন। আমরা দেখছি যে রিপাবলিকানরা আমাদের গণতন্ত্রকে সব দিক থেকেই আক্রমণ শুরু করেছে।
তবে গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা জেগে উঠেছেন। কিন্তু মানুষদের অবশ্যই বুঝতে হবে সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত কিসের অংশ। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি নিপীড়নমূলক শাসনের অধীন নিয়ে যেতে চায় তারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১০১৫
আপনার মতামত জানানঃ