ভোজ্য তেলের পর এবার চিনি নিয়ে কারসাজি করছে একটি চক্র। বাজার থেকে অনেকটা ‘উধাও’ হয়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। যা স্মরণকালের সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার দাম ঠিক করে দেয়ার পরও তিন থেকে চারদিনের ভেতরে চিনির দাম ফের কেজিপ্রতি ১৫-২০ টাকা বাড়ায় ক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর অন্যতম কাওরান বাজারের পাশাপাশি মহাখালী বাজার ও তুরাগ এলাকার নতুনবাজারে খোঁজ নিয়ে এ অবস্থা দেখা যায় বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মিল থেকে চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই তাদের দোকানেও কোনো চিনি নেই। তারা বলেন, মিলাররা জানিয়েছে, চিনির দাম আরো বাড়বে।
জানা যায়, গত ৬ অক্টোবর সরকার প্রতি কেজি চিনিতে ছয় টাকা বাড়িয়ে খোলা চিনির দাম ৯০ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, মূলত :দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গতকাল তাদের বাজারদরের প্রতিবেদনে খুচরাবাজারে চিনি না পাওয়ার বিষয়টি না জানালেও সংস্থাটি জানিয়েছে, বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, যে দুই-একটি দোকানে চিনি পাওয়া গেছে তা প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিক্রেতা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মিল থেকে কোনো চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই তাদের দোকানে কোনো চিনি নেই।
তিনি বলেন, সরকার কয়েক দিন আগে চিনির যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, চিনি কোম্পানিগুলো সে দরে চিনি বিক্রি করতে আগ্রহী না। মিলাররা আরো বেশি দাম বাড়াবে বলে সরবরাহকারীরা আমাদের জানিয়েছেন।
মিরপুরের শেওড়াপাড়ার খুচরা চিনি বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তিনদিন আগেও ৫০ কেজির চিনির বস্তা কিনেছি ৪২৫০ টাকায়, সেটা আজ ৫৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ১০৫০ টাকা বেড়েছে।
তিনি আরো বলেন, ১০৬ টাকা করে কিনে ১১০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অস্বাভাবিক বাজারে পণ্য কিনতেও ভয় লাগে। বাজার দাম কমে গেলে লসে বিক্রি করতে হবে। তবে এর আগে কখনো চিনির দাম ১০০ টাকার বেশি ওঠেনি।
মহাখালীর বাসিন্দা এক ক্রেতা বলেন, মহাখালী বাজারে তিনি চিনি না পেয়ে কাওরান বাজারে এসেছেন। কিন্তু এখানেও তিনি চিনি পাননি। অনেকটা আক্ষেপ করে তিনি বলেন, চিনিতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। শিশুরা তাদের খাবারে চিনির ওপর নির্ভরশীল। তাই সরকারের উচিত হটাত্ করে চিনির সংকট কেন হলো তা খুঁজে বের করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
মিলাররা জানিয়েছেন, গ্যাস সংকটের কারণে চিনি পরিশোধন কারখানাগুলো চাহিদামতো চিনি পরিশোধন করতে পারছে না। ফলে চিনির উত্পাদন কমেছে।
ক্রেতারা বলছেন, জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা খেলায় মেতেছেন। তারা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না। নিজেদের ইচ্ছা মতো দাম বাড়াচ্ছে।
আর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে তাদের উৎপাদন কমেছে। যার জন্য বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
কেন এই সংকট
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা গণমাধ্যমকে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “সম্প্রতি চিনি শিল্প অনেকগুলো সঙ্কট মোকাবেলা করছে। এলসি ওপেন করা যাচ্ছে না, ডলারের অনেক উচ্চমূল্য এগুলোতে আছেই। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে পরিশোধন ইউনিটে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া।
“গ্যাস না থাকার কারণে প্রায় সবগুলো মিলেরই কর্মঘণ্টা কমে ছয় ঘণ্টায় নেমে এসেছে। অথচ এই চিনিকলগুলো আগে ২৪ ঘণ্টায় উৎপাদনে থাকত। গ্যাসের সমস্যার সমাধান না হলে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক করা যাবে না।
জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা খেলায় মেতেছেন। তারা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না। নিজেদের ইচ্ছা মতো দাম বাড়াচ্ছে।
গ্যাসের সঙ্কটের কারণে গত একমাস ধরেই চিনি উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “সারাদিনে মোটের ওপর ছয় ঘণ্টা গ্যাস পাচ্ছি কারখানা চালাতে। সরকার গ্যাস নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো ফল আসছে না। আমরা বলেছি এভাবে গ্যাস আসা যাওয়ার কারণে আমাদের কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে, ইঞ্জিনের ক্ষতি হচ্ছে।
“সেজন্য আমরা প্রস্তাব করেছি যে, প্রয়োজনে এক সপ্তাহ টানা গ্যাস দিয়ে এক সপ্তাহ বন্ধ রাখা হোক। আগে যেখানে দৈনিক তিন হাজার থেকে ৩২০০ টন চিনি সরবরাহ করা যেত, সেখানে এখন এক হাজার থেকে ১২০০ টন দেওয়া যাচ্ছে।”
দেশবন্ধু চিনি কলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, সরকার এখন যে দাম নির্ধারণ করেছে, সেটাও ‘যথাযথ হয়নি’।
“আমরা বার বার সরকারকে বলছি যে, সব খরচ বিশ্লেষণ করে চিনির একটা সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। কিন্তু সরকারের দিক থেকে কোনো দাবিই পূরণ করা হচ্ছে না। এখন প্রতি কেজিতে যে ৩২ টাকা করে শুল্ক দিতে হচ্ছে, সেখান থেকেও কমাতে পারে।
“এটা ঠিক যে আমাদেরকে সরবরাহের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দিতে হয়েছে। এর বাইরে কেউ কোথাও মজুদ করছে কিনা সেটা আমরা বলতে পারবো না।”
‘আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার অস্থিতিশীল করেছে’
ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজার কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে।
এই বিষয়ে সিটি গ্রুপের ডিজিএম (সেলস) প্রদীপ করণ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির বুকিং দর কমেছে তা ঠিক। তবে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে তাদের আমদানি মূল্য পরিশোধে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের কম বুকিং দরের সুফলটা তারা পাচ্ছে না।
“এছাড়া চিনির নিয়ন্ত্রিত শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে পূর্বের ন্যায় ৩০ শতাংশ করায় তাদের খরচ বেড়েছে। ফলে দেশীয় বাজারে পণ্যটির দাম কমানো যাচ্ছে না,” যোগ করেন তিনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি অর্থবছরের গেল তিন মাসে চিনির আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু গেল অর্থবছরে পণ্যটির আমদানি ছিল আগের চেয়ে প্রায় ৪ লাখ টন। আমদানি সংকটের ওই সুযোগটিকে কাজে লাগিয় মূলত গত তিন মাস ধরে চিনির বাজারকে অস্থির করে তুলেছে আমদানিকারক ও কারখানা মালিকরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস’র তথ্যমতে, গেল অর্থবছরে (২০২১-২২) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মাত্র ১৭ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনি আমদানি হয়েছিল ২১ লাখ টন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্ল্যাহ বলেন, “বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে সরকার নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল ও চিনি বিক্রির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। পাইকারিতে দাম বাড়লে খুচরায় দাম সমন্বয়ের বিষয়টি দেখবে সরকার।”
“কিন্তু কোনো ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রির সুযোগ নেই। আমরা এই বিষয়টি আরো জোরালোভাবে মনিটরিং করবো,” যোগ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, মহামারি করোনা এরই মধ্যে আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আমাদের অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। কমবেশি সবার মধ্যেই পড়েছে এর নেগেটিভ প্রভাব। অনেকে সবকিছু হারিয়ে অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে। অন্তত সাধারণ জনগণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর যেন ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সহনশীল মাত্রায় মূল্য নির্ধারণের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে।
তারা মনে করেন, নিত্যপণ্যের বাজরদর নিয়ন্ত্রণে সর্বপ্রথম দরকার অসাধু বাণিজ্য সিন্ডিকেট শনাক্ত করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। এ ক্ষেত্রে দোষীদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৬
আপনার মতামত জানানঃ