মানুষ হিসেবে মানুষের চিন্তা করার ও নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। তা স্বত্বেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের এই যুগে প্রাপ্য অধিকারগুলো পরিপূর্ণরূপে ভোগ করার পরিবর্তে উদ্বেগজনকভাবে মৌলিক স্বাধীনতা হরণের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউস বলেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতায় বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
ফ্রিডম অন দ্য নেট ২০২২’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০০ তে ৪৩ নাম্বার পেয়েছে বাংলাদেশ। ভারত ও শ্রীলঙ্কা যথাক্রমে ৫১ পয়েন্ট ও ৪৮ পয়েন্ট অর্জন করেছে।
বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ইন্টারনেট ব্যবহারে ‘আংশিক স্বাধীনতা’ পেয়ে থাকে।
ফ্রিডম হাউজের ইন্টারনেট ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘আংশিকভাবে স্বাধীন’ দেশের ক্যাটাগরিতে রয়েছে। কোনো সরকার কীভাবে কোনো দেশের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল পরিসর নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সর করে থাকে তার ভিত্তিতে এই সূচক প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
২০২১ সালের ১ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত বিশ্বের ৭০টি দেশে ইন্টারনেট অ্যাক্সেসে বাধা, কনটেন্ট সীমিতকরণ এবং ব্যবহারকারীর অধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত ২১টি নির্দেশকের ওপর ভিত্তি করে ইন্টারনেট স্বাধীনতা সূচক প্রকাশিত হয়।
দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার পরিধি ও ইন্টারনেটের গতি বাড়লেও ব্যয়, ভৌগোলিক ও লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের কারণে এই ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সীমাবদ্ধ’, বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
‘শারদীয় দুর্গাপূজার সময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর একের পর এক আক্রমণের মধ্যে কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালের অক্টোবরে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। অনলাইনে পোস্ট করা ভিডিওগুলো অনেকাংশেই উস্কানি হিসেবে কাজ করেছিল,’ বলা হয় প্রতিবেদনে।
সেখানে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বিগত বছরগুলোতে অনলাইন ক্যাম্পেইন আয়োজন করে, যা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিজমের উপযোগী পরিবেশ থাকার বিষয় নির্দেশ করে’।
ব্যবহারকারীরা অনলাইন বিচরণে খুব বেশি বিধিনিষেধের মধ্যে না পড়লেও বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা এখনও কম বলেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিএসএ)-র অধীনে সরকার, মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের অনলাইনে সমালোচনাকারীদের প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হয়, যা অনলাইনে স্বআরোপিত সেন্সরশিপ বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে বলে মন্তব্য করা হয়।
মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের অনলাইনে সমালোচনাকারীদের প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হয়, যা অনলাইনে স্বআরোপিত সেন্সরশিপ বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও নজরদারি সরঞ্জামের পেছনে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে ও কভারেজ সময়কালে প্রবর্তিত খসড়া আইনগুলো বাংলাদেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ডেটা অপব্যবহারের ঝুঁকি আরও বাড়াবে’।
‘কর্মকর্তারা অনলাইন কনটেন্ট সেন্সর করতে প্রযুক্তিগত দক্ষতার পাশাপাশি আইনি কর্তৃত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন’।
ইন্টারনেট স্বাধীনতা রেটিংগুলো তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছ। এগুলো হলো- স্বাধীন, আংশিক স্বাধীন এবং স্বাধীন নয়। ৭০ থেকে ১০০ পর্যন্ত স্কোর তোলা দেশগুলো স্বাধীন, ৪০-৬৯ পর্যন্ত স্কোর করা দেশগুলো আংশিক স্বাধীন এবং ৩৯ এর নিচে স্কোর করা দেশগুলো ইন্টারনেট ব্যবহারে ‘স্বাধীন নয়’ ক্যাটাগরিতে জায়গা পেয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পাকিস্তানে অনলাইন পরিসর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। পাকিস্তান মাত্র ২৬ নাম্বার পেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারে ‘স্বাধীন নয়’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী টানা ১২ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতা কমছে।
২৮ দেশে অনলাইনে মানবাধিকার পরিবেশের অবনতি হয়েছে। তবে সূচক প্রকাশের পর এবারই প্রথম সর্বোচ্চ ২৬টি দেশে অবস্থার উন্নতি ঘটতে দেখা গেছে।
সবচেয়ে বেশি অবনমন ঘটেছে রাশিয়ায়। অবনতিতে এরপরই ছিল যথাক্রমে মিয়ানমার, সুদান এবং লিবিয়া। তবে গাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ে বড় উন্নতি করেছে।
ইন্টারনেট ব্যবহারে স্বাধীনতা সূচকে আবারও শীর্ষস্থান দখল করেছে আইসল্যান্ড। অন্যদিকে চীন টানা ৮ বছরের মতো এবারও ইন্টারনেট ব্যবহারে সবচেয়ে কম স্বাধীনতা পেয়েছে।
ইন্টারনেটে অবারিত নজরদারিতে আমাদের প্রায় কোনো তথ্যই আজ গোপন থাকছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক, অ্যাপস, ই-মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সার্চ ইঞ্জিন- ইন্টারনেট সংশ্নিষ্ট সব সেবাই আমাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে রাখছে। জেনে অথবা অজান্তে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের ট্র্যাকিংয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছি।
ডিজিটাল পরিসরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মতামত প্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ এটি জনগণকে তথ্য ও ধারণার অবাধ প্রবাহের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে সক্ষম করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তিগত বিকাশের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি আমাদের মতবিরোধ এবং শোনার অধিকার দেয়। বিভিন্ন চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশের দ্বারা আমরা আমাদের মৌলিক বিশ্বাস সম্পর্কে নিজস্ব পছন্দ পোষণ করতে পারি।
তারা বলেন, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা— এটা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। যে অধিকার আইন করেও খর্ব করা যায় না। দুর্ভাগ্যবশত আজকে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন করার পরও আমরা এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ