মিজানুর রহমান। ঢাকা রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সে (আরআরএফ) পুলিশ সুপার (কমান্ড্যান্ট) হিসেবে দায়িত্বরত। তবে দাপ্তরিক কাজে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ব্রাকেটে লিখে থাকেন ‘উচ্চ আদালতের রায়ে ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত’।
এসপি পদে থেকে ডিআইজি র্যাংক ব্যাজ পরা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে উচ্চ আদালতের এক আদেশের রেফারেন্স টানেন মিজানুর রহমান। যদিও সেই রায়ে বলা আছে- ‘পদোন্নতিতে বাধা নেই’। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তের পরোয়া করেন না তিনি।
নিজেকে সব সময় পরিচয় দেন প্রভাবশালী এক পরিবারের আত্মীয় হিসেবে। ইতোমধ্যে অদৃশ্য ইশারায় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আসা অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত এড়িয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে অপকর্মের নানা অভিযোগ।
পুলিশ বিভাগ বলছে, আদালতের রায়ের কপি তাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। রায়ে কী লেখা আছে তা দেখে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে তারা। আদালত যদি মীজানকে পদোন্নতি দিয়ে থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে আইনি লড়াই করবে পুলিশ সদর দপ্তর।
অভিযোগে ভারাক্রান্ত এসপির কাঁধ
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আদালত যদি তার পদোন্নতির রায় দিয়ে থাকে তা প্রতিপালনের দায়িত্ব পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তিনি পুলিশ সদর দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে সেই সুযোগ দেননি। তার আগেই তিনি কাগজে-কলমে পুলিশ সুপার পদে থেকে ডিআইজি র্যাংক ব্যাজ পরিধান করে চলেছেন। পুলিশের মতো একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনোভাবেই এমনটা আশা করা যায় না।
মীজানের বিতর্কিত কার্যক্রমের এখানেই শেষ নয়। তার উল্টোপাল্টা আচরণে আগেও বহুবার বিব্রত ও অপ্রস্তুত হয়েছে পুলিশ বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
২০১২ সাল থেকে মিজানের বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান হলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরও তাকে দায়মুক্তি দিয়েছিল সংস্থাটি।
তার বিরুদ্ধে ভেজাল সারের কারখানা খুলে জালিয়াতির ব্যবসা, পুলিশ দিয়ে জমি দখল করে পদস্থ কর্মকর্তাদের নামে সাইনবোর্ড টাঙানো, বাড়ি বানানোয় ৬০ পুলিশকে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে ব্যবহার, প্রভাবশালী পরিবারের দোহাই দিয়ে দুদকের তদন্ত থেকে অব্যাহতি, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি অর্জন, কনস্টেবল রিলিজে উৎকোচ গ্রহণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
বাস্তবতা হলো, এতসবের পরও রহস্যজনক কারণে মীজানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। একের পর এক বাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলেও চুপ পুলিশ সদর দপ্তর।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, আদালতের নাম ব্যবহার করে একদিকে পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন মীজান; অন্যদিকে ডিআইজি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে মন্ত্রণালয়ে জোর তদবির চালাচ্ছেন। একজন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তার এভাবে লাগাতার অপকর্ম পুলিশ বিভাগের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।
উল্লেখ্য, মিজানুর রহমান ১৯৮৯ সালে উপপরিদর্শক পদে পুলিশে যোগ দেন। পরে ১৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর ১৯৯৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার, ২০০৩ সালে অ্যাডিশনাল এসপি ও ২০০৬ সালে এসপি হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এই কর্মকর্তা।
ওই পদে থেকেই ২০১৮ সালের ৩ জুলাই ডিআইজি হিসেবে র্যাংক ব্যাজ পরা শুরু করেন তিনি। এর আগে জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগে ২০১০ সালে বাগেরহাটের এসপির পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল তাকে।
বাড়ি নির্মাণে জোগালি পুলিশ
দুদক সূত্র জানায়, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন পুলিশ সদস্যদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে দুদকের হাতে। এসপি মিজান সাভারের হেমায়েতপুরের আলিপুর ব্রিজ-সংলগ্ন জগন্নাথপুরে প্রায় ৮৪ শতাংশ জায়গার ওপরে তৈরি করেছেন আলিশান বাড়ি। ওই কাজে মাত্র তিনজন পেশাদার রাজমিস্ত্রির সঙ্গে হেলপার বা জোগালি হিসেবে ব্যবহার করছেন সাব-ইন্সপেক্টরসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় ৬০ জন পুলিশ সদস্য।
নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে পুলিশের গাড়ি। প্রায় একই অভিযোগ রয়েছে রাজধানীর মিরপুরের আলমাস টাওয়ারের পাশে ও নরসিংদীর পলাশে তার আরও বাড়ি নির্মাণে। পুলিশ প্রবিধানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, পুলিশের প্রতিটি সদস্য প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো যাবে না।
নকল সার কারখানা পরিচালনা
দুদকে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, এসপি মিজান ফসল উৎপাদনে বহুল ব্যবহৃত টিএসপি বা ট্রিপল সুপার ফসফেট সার নকল করার চারটি বড় কারখানার পরিচালনা করেন। এর মধ্যে দুটি কারখানা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আর অন্য দুটি ঢাকার অদূরে হেমায়েতপুরে।
ওই চারটি কারখানায় প্রতিদিন এক হাজার টন নকল টিএসপি সার তৈরি করা হয়, যার দাম প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর এসব সার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সরকারি টিএসপি সারের বস্তায় ভরে। কিছু সার বিক্রি হয় ‘তিউনিসিয়া টিএসপি’ নামে।
গণমাধ্যমে এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দুদক তা আমলে নেয় এবং এ-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ
মিজানুর রহমানের নানা সম্পদের তথ্যও রয়েছে দুদকের হাতে। হেমায়েতপুর, মিরপুর মাজার রোড, নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্থানে মিজানুর রহমানের স্থাবর সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করেছে দুদক। সেগুলোর পাশাপাশি অস্থাবর সম্পদের তথ্যও নেওয়া হয়েছে।
অদৃশ্য প্রভাবে বারবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে মিজান
তবে ২০১২ সালে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদক যে অনুসন্ধান করেছে, তখন সংস্থার চারজন কর্মকর্তা আলাদাভাবে অনুসন্ধান করেও তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাননি।
একাধিকবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করেও মামলা করার মতো কিছু পায়নি দুদক। তাই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে মিজানকে অব্যাহতি দিয়েছিল সংস্থাটি।
তবে এ বিষয়ে দুদকেও কানাঘুষা ছিল। প্রভাব খাটিয়ে দুদক থেকে দায়মুক্তির সনদ নিয়েছিলেন বলে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছিল।
দুদক সূত্র জানায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে অনুসন্ধান শুরু হয়। উপপরিচালক গোলাম মোরশেদ অনুসন্ধান শুরু করলেও পরে আরেক উপপরিচালক ফজলুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দুজনই মিজানুর রহমানকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দিলেও কমিশন তা গ্রহণ করেনি। পরে আবার অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় উপপরিচালক হামিদুল হাসানকে। হামিদুল হাসানও অভিযোগটি নথিভুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুপারিশ করেন। এ সুপারিশ অগ্রাহ্য করে উপপরিচালক মো. আবদুস সোবহানকে পুনঃ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয় কমিশন।
দুদকে আসা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৪ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮ বছরে তিনি কয়েক শ বিঘা স্থাবর সম্পত্তি কিনেছেন। ব্যাংকে তার নগদ অর্থ রয়েছে ১০ কোটি টাকার বেশি। তার স্ত্রীর নামে লাইসেন্স নেওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বৈধ করেন।
এসব রেকর্ডে মিজানের স্ত্রী নীপা মিজানের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চান অনুসন্ধান কর্মকর্তা হামিদুল হাসান। কিন্তু কমিশনের ওপর মহল থেকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে অদৃশ্য ইশারায় অনুসন্ধান নথিভুক্তির সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ