দেশের সবচেয়ে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির কাগজে কলমে দেনা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আর বাস্তবে প্রায় হাজার কোটি। অথচ ব্যাংকে আছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, টাকা গেল কোথায়?
প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিপুল টাকার কোনো হদিস নেই৷ বেশিরভাগ টাকার লেনদেন করেছে নগদে৷ ইভ্যালি নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে৷
এতে আরও বলা হয়, এই অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং হয়েছে কি না, যা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তদন্তের বিষয়৷ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ইভ্যালির ওপর এই নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিদায়ী পর্ষদ৷ গত ৩১ আগস্ট নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি ইভ্যালির পর্ষদের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়৷ বলা হয়, একটি ভালো নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি৷
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বিপুল ছাড়ে পণ্য বিক্রির কথা বলে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ রাসেল কারাগারে থাকলেও তার স্ত্রী শামীমা গত এপ্রিল থেকে জামিনে আছেন৷
রাসেল কারাগারে যাওয়ার পর আদালত ইভ্যালি পরিচালনায় চার সদস্যের একটি পর্ষদ গঠন করেন৷ ওই পর্ষদই নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি করায়, যেটি ২২ সেপ্টেম্বর আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইভ্যালির বাণিজ্যিক কার্যক্রম কোনোভাবেই টেকসই ছিল না৷ কোম্পানিটি মুনাফামুখী প্রতিষ্ঠানের কাঠামোতে পরিচালিত হয়নি৷ সার্বিকভাবে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল ছিল৷ এটি শতভাগ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ইচ্ছায় পরিচালিত হয়েছে, কোনো করপোরেট কাঠামো ছিল না৷
ইভ্যালি যে লেনদেন করেছে, তার হিসাবেও গরমিল রয়েছে৷ লেনদেনের সঙ্গে নথির অসংগতি আছে৷ গরমিল আছে সরকারের শুল্ক-কর প্রদানের সঙ্গে হিসাব–নিকাশের মধ্যেও৷
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা, তথ্য সংরক্ষণ, লেনদেন ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে৷ এতে বলা হয়, ব্যাংক ও মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইভ্যালি যে লেনদেন করেছে, তার হিসাবেও গরমিল রয়েছে৷ লেনদেনের সঙ্গে নথির অসংগতি আছে৷ গরমিল আছে সরকারের শুল্ক-কর প্রদানের সঙ্গে হিসাব–নিকাশের মধ্যেও৷
নিরীক্ষাকালে প্রতিষ্ঠানটির কাছে শুল্ক-কর, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন, মামলা-মোকদ্দমার তথ্য, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, আর্থিক লেনদেন—এসব তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷ বলা হয়, কোম্পানিটি পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল৷ কোম্পানিতে প্রধান আর্থিক কর্মকর্তার (সিএফও) পদ খালি ছিল৷ কর্মকর্তা ও কর্মীরা উচ্চ বেতনে চাকরি করলেও তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ দেখা যায়নি৷
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদনে লিখেছে, তারা ইভ্যালির ব্যবসা পরিচালনার স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চেয়েছিল, কিন্তু পায়নি৷ তাদের সার্বিক মত হলো প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় কৌশল ছিল খুবই দুর্বল৷ রাসেল ও শামীমা ইভ্যালির ব্যবসা সম্প্রসারণ করলেও তাদের ততটা মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল না বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে৷
এতে আরও বলা হয়, গ্রাহকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ইভ্যালি ব্যবসা করেছে৷ স্বল্পসংখ্যক গ্রাহককে পণ্য দিলেও বিপুলসংখ্যককে তা দিতে পারেনি৷
ইভ্যালিতে আদালতের নির্দেশে গঠিত পর্ষদ গত ১৯ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে৷ এর আগে শামীমা তার মালিকানার একটা অংশ মা ও ভগ্নিপতিকে দেন৷ সম্প্রতি আদালতের নির্দেশে শামীমা, তার মা ফরিদা আক্তার ও ভগ্নিপতি মামুনুর রশীদ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব কাজী কামরুন নাহার ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সহসভাপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিনকে নিয়ে ইভ্যালির নতুন পর্যালোচনা পর্ষদ হয়েছে৷
বিপুলসংখ্যক গ্রাহক এখনো ইভ্যালির কাছে টাকা পায়৷ পাওনার আসল পরিমাণ কত, তা জানা যায়নি৷
২০১৬ সালে অনলাইন মার্কেট প্লেসে শিশুদের ডায়াপার বিক্রির মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ রাসেলের যাত্রা শুরু। ২০১৭ সালে এই ব্যবসা চলমান থাকা অবস্থায় বড় একটি অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরির পরিকল্পনা করেন তিনি। সেই পরিকল্পনার বাস্তব রূপ দিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশীয় ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালী। প্রায় ১৭ লাখ নিয়মিত ক্রেতা, ২০ হাজারের বেশি বিক্রেতা নিয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম সারিতে উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটি। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর ক্যাশব্যাকের আকর্ষণ দিয়ে ক্রেতা বাড়ানোর কৌশল নিয়ে দৃশ্যত সফল হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন গ্রাহক ভোগান্তির চূড়ায় অবস্থান করছে।
ক্যাশব্যাক দীর্ঘদিন কোম্পানির হিসাবে পড়ে থাকলেও জটিল নিয়মের কারণে গ্রাহক তা ক্যাশ (নগদায়ন) করাতে পারে না। মোটরসাইকেল, গাড়ি, মোবাইল, বাসা-বাড়ির সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রের মতো উচ্চমূল্যের পণ্যে লোভনীয় ছাড় দেয় ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠার শুরুতে সাইক্লোন, আর্থকোয়েক ইত্যাদি নামে তারা ক্রেতাদের ১০০ থেকে দেড়শ’ শতাংশ ক্যাশব্যাকের মতো অত্যন্ত লোভনীয় অফার দেয়। ইভ্যালির ব্যবসার এ কৌশলের ফলে মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অনেক সমালোচনারও সৃষ্টি হয়।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণার অভিযোগ আসলেও কোনো গ্রাহক সরাসরি আইনের আশ্রয় নেয়নি। যে কারণে ইভ্যালি গ্রাহকদের পণ্য কিংবা রিফান্ড দিতে অনেকটা ইচ্ছেমত তালবাহানা করে আসছিলো। অর্ডার দেয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিলেও অসংখ্য গ্রাহকের ৮-১০ মাস পার হয়ে যেত, পণ্য পেতেন না।
রিফান্ডের জন্য আবেদন করেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হতো। তবে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অস্বাভাবিক ছাড়ে পন্য দেয়ার বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন খোঁজখবর করতে গেলে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে অনেক অজানা প্রতারণার তথ্য।
রাসেল তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে র্যাবকে জানিয়েছেন, ইভ্যালিকে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নামে চিনবে এমন একটি পরিচিতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করেছেন। তার গ্রাহকসংখ্যা ৭০ লাখ হলেও কেউ বিনিয়োগ করতে রাজি হননি। কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেও তাদের অস্বচ্ছতার কারণে পিছিয়ে গেছে।
রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা করে বেতন নিতেন। তারা প্রতিষ্ঠানের অর্থে কেনা দামি রেঞ্জ রোভার ও অডি ব্র্যান্ডের দুটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। বর্তমানে ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ টাকা আছে
বিভিন্ন সংস্থায় প্রকাশিত এই বিপুল পরিমাণ দেনার বিষয়ে র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। রাসেল বিদেশে কোনো টাকা পাচার করেননি। অপরদিকে, ইভ্যালির ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু সংস্থা তদন্ত করছে আরো আগে থেকেই। তবে এখন পর্যন্ত কেউই ইভ্যালির অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য সামনে আনতে পারেনি। তাহলে তিন বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন করা প্রতিষ্ঠানটির মুনাফার অর্থ গেলো কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করা গ্রাহকদের পাওনা হাজার কোটি টাকাই বা কী করেছেন রাসেল?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ