প্রায় প্রতি রাতে বঙ্গোপসাগরের কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে মাছ ধরার ট্রলার বা বোট বোঝাই করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সাগরপথে মানুষ পাঠানো হচ্ছে। কয়েক বছর আগে সাগরে অসংখ্য মানুষের সলিল সমাধি ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নির্যাতনে গণকবরের সন্ধানে এ পথে বাংলাদেশিদের মালয়েশিয়া যাওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা এ পথকে সহজ ভেবে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ট্রলারডুবির ঘটনায় তিন রোহিঙ্গা নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে টেকনাফের বাহারছড়ার শীলখালী এলাকা থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও কোস্টগার্ড সদস্যরা। এই ঘটনায় ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আট জন নারী।
৪৫ জনকে উদ্ধার করা হলেও আরও অসংখ্য যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
নিখোঁজ যাত্রীদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তবে সাগর থেকে সাঁতার কেটে যারা তীরে ফিরে এসেছেন, তাদের কোস্টগার্ড ও পুলিশ আটক করেছে বলে জানা গেছে।
উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শিলখাল, বান্নাপাড়া ও হলবনিয়ায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাহারছড়া পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক নুর মোহাম্মদ জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির ঘটনায় ভেসে আসা তিন নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের নাম জানা যায়নি। এ ঘটনায় ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধার রোহিঙ্গাদের কয়েকজন বলছেন, মালয়েশিয়ার যাওয়ার উদ্দেশ্যে গতরাতে ট্রলারে ওঠেন তারা। ট্রলারে প্রায় ৮৫ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে ৬৫ জন রোহিঙ্গা।
ট্রলারডুবির ঘটনায় বেঁচে ফেরা টেকনাফের শালবনের বাসিন্দা রোকসা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় রয়েছে। তার কাছে যাওয়ার জন্য সাগরপথ পাড়ি দিচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এর আগেও যাত্রা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। ট্রলারে আরও অনেক নারী ও শিশু ছিল। তাদের মরদেহ সাগরে ভাসতে দেখেছি।’
বাহারছড়া কোস্ট গার্ড স্টেশনের কনটিজেন্ট কমান্ডার দেলোয়ার হোসেন জানান, গতকাল রাতে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে কয়েকজন দালাল রোহিঙ্গাদের নিয়ে অবৈধভাবে সাগরপথে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু বাহারছড়া উপকূলে এসে ট্রলারটি ডুবে যায়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৪৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি চার জন। তারা মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য। বাকিরা কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। এখনও উদ্ধার কার্যক্রম চলছে।
কক্সবাজারে মানবপাচার চক্রের বিষয়টি বহুল আলোচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কিছু পাচারকারীকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হলেও এসব চক্রের বহু সদস্য থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কক্সবাজারে বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দারা সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে আর মালয়েশিয়া যেতে চায় না। তাই মানবপাচারে জড়িত দালালরা এবার টার্গেট করেছে রোহিঙ্গাদের। পাশাপাশি সাগরপথে মানবপাচারের পুরানো ঘাট ও দালালরা নানা কৌশলে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রোহিঙ্গা দালাল চক্র। তাদের সঙ্গে এই অপকর্মে স্থানীয় কিছু অর্থলোভী অসাধু ব্যক্তিও রয়েছে।
জানা যায়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অতি আগ্রহে টার্গেট করেছে পাচারকারী দালাল চক্রের সদস্যরা। তারা প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে। এর আগেও একাধিক সময় টেকনাফ উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার চলেছে। তবে সে সময় রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাংলাদেশির সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
তথ্যসূত্রে দেখা যায়, গত কয়েক মাসের মধ্যে সাগরপথে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় এ পর্যন্ত হাজারো রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তথ্য নিয়ে জানা যায়, সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের মধ্যে সুন্দরী নারীর সংখ্যা বেশি। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে বিয়ে দিতে দালালরা সুন্দরী নারীদের টার্গেট করে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে সেদেশে পাচার করছে।
এছাড়া অনেক বিবাহিত নারীও তাদের শিশু সন্তানসহ সেখানে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দালালদের কাছে ধরণা দিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসরত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা সংবাদমাধ্যমকে জানান, সাগরপথে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রোহিঙ্গা দালাল চক্র। তাদের সঙ্গে এই অপকর্মে স্থানীয় কিছু অর্থলোভী অসাধু ব্যক্তিও রয়েছে।
মানব পাচার বাংলাদেশের অন্যতম শিরঃপীড়ায় পরিণত হয়েছে। জল-স্থল-আকাশপথে প্রতিদিন মানব পাচার চলছে। মূলত জীবন ও জীবিকার কারণে, দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে, দারিদ্র্যের পীড়নে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এ সব মানুষের বেশির ভাগই প্রতারিত হচ্ছে, হচ্ছে সর্বস্বান্ত। ‘একটা সময় শুধু রোহিঙ্গা পুরুষরা কাজের তাগিদে সাগর পাড়ি দিতেন। এখন কিন্তু নারী ও শিশু পাচারও বাড়ছে। অবৈধভাবে দেশের বাইরে যাওয়ায় বাংলাদেশের অনেক অভিবাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছেন। চলাচলে সীমাবদ্ধতা, ঋণের চক্রে পড়া, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নির্যাতন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মতো শোষণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন অভিবাসীরা। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারী ও পুরুষ এবং শিশুরাই মানব পাচারকারীদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, তারা মনে করে কোনোভাবে একবার থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় যেতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। মাসে লাখ টাকা উপার্জন করা যাবে- এমন মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে সাগর পথে বিদেশে পাড়ি জামাতে গিয়ে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন লোকজন। এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আর এই মানবপাচারকারীদের মূল্য লক্ষ্য এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতারা বলেছেন, উন্নত জীবনের আশা এবং বিয়ে প্রলোভনে তরুণীরা সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিচ্ছেন। দালালরা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ফাঁদে ফেলছে। মানব পাচার রোধ করা না গেলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
তারা মনে করেন, মানব পাচার বন্ধ না হলে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ যে মানবতার পরিচিতি পেয়েছে সেই ভার্বমূতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কাজেই কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও বিজিবিসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও নজরদারি বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনে সীমান্তের সক্ষমতা বাড়িয়ে, পাচার বন্ধ করতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ