হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের লাগেজ কাটা, চুরি চলছেই। বরাবরই অভিযুক্ত বিমানবন্দর অথবা এয়ারলাইনস কর্মীরা।
বিমানবন্দরে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের মালামাল চুরির ঘটনার বিষয়টি সম্প্রতি সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া খেলোয়াড়দের ডলার চুরি হওয়ার পর আবারো সামনে এসেছে। মালামাল চুরির বিষয়ে অনেক যাত্রী বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অভিযোগ করে থাকেন।
জানা গেছে, ঢাকার হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাগেজ হয়রানি চরমে পৌঁছেছে। এ থেকে বাদ যাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রী থেকে ভিআইপিরাও। বিমানযাত্রীরা প্রতিনিয়ত এই বিমানবন্দরে লাগেজ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি বিমানযাত্রীদের লাগেজ থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী। কিন্তু এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানে নেপাল থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন ফুটবল দলের সদস্যরা। বিমানবন্দরে নামার পর বাংলাদেশে দলের ফুটবলার কৃষ্ণা রানী সরকার দেখতে পারেন তার লাগেজ ভাঙা। ডলার, টাকা ও উপহারসামগ্রী উধাও।
বাফুফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কৃষ্ণা রানী সরকারের ব্যাগ থেকে ৫০০ ডলার এবং ৫০ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। এছাড়া সানজিদা আক্তারের ব্যাগ থেকে ৫০০ ডলার ও শামসুন্নাহারের ব্যাগ থেকে হারিয়েছে ৪০০ ডলার।
ঢাকার বিমানবন্দরে নামার পর লাগেজ না যাওয়া কিংবা লাগেজের ভেতরের মালামাল বুঝে না পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। সংবাদমাধ্যমে এরকম প্রায়ই যাদের লাগেজ চুরি হয় তাদের ভোগান্তির খবর আসে।
সৌদি প্রবাসী কর্মী এসএম ইসহাক গত ৮ জুলাই তার ৩টি লাগেজের মধ্যে একটি কাটা দেখতে পান। এর ভেতরে থাকা অনেক জিনিস আর পাননি তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাঈদ-সেঁজুতি দম্পতি গত ১০ জানুয়ারি বিমান বন্দরে তাদের লাগেজ হারান। এখনো ফিরে পাননি।
সৌদি প্রবাসী শ্যামল আহমেদ গত বছরের নভেম্বরে দেশে ফেরার সময় বিমান বন্দরে তার লাগেজ হারিয়ে যায়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি তার মালামাল ফেরত পাননি।
এ চক্রে জড়িত ২০-২৫ জন একাধিকবার সিআইডি এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জানা গেছে, চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ আবার আইনি কৌশলে বিমানবন্দরে ফিরেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লাগেজ গায়েব বা মালামাল চুরিতে বিমানের কর্মীরা জড়িত। এর প্রমাণও মিলেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এ চক্রে জড়িত ২০-২৫ জন একাধিকবার সিআইডি এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের (এপিবিএন) হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জানা গেছে, চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তাদের কেউ কেউ আবার আইনি কৌশলে বিমানবন্দরে ফিরেছেন।
এদিকে গত এক বছরে বিমান এবং সিভিল অ্যাভিয়েশনের বেশ কয়েকজন কর্মচারীকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেও চুরি থামছে না।
একাধিক সূত্র জানায়, কর্মচারীদের মধ্যেই বিমানবন্দরে একটি চোর চক্র আছে। তারা বেশ শক্তিশালী।
বিমান বন্দর সূত্র জানায়, প্রতিদিন সেখানকার লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগে একশ’রও বেশি অভিযোগ আসে। এগুলোর ৯০ ভাগেরও বেশি চুরির ঘটনা। তবে তার একটি অংশ পরে পাওয়া যায়। নিয়ম হলো পাওয়া না গেলে ২০ কেজি মালামালের জন্য প্রতি কেজিতে ২০ ডলার করে ক্ষতিপুরণ দেয়া হয়। আর তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ ডলার ক্ষতিপুরণ দেয়ার নিয়ম আছে। তবে এই ক্ষতিপুরণ পাওয়াও বিশাল এক ঝামেলার ব্যাপার।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, আমি সাড়ে পাঁচ মাস আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমাদের বিমান বন্দর থেকে কোনো লাগেজ চুরি বা কাটার লিখিত অভিযোগ পাইনি। আর নারী ফুটবলারদের ঘটনা আমাদের এখান থেকে হয়নি। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তা নিশ্চিত হয়েছি।
তার দাবী, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সব খানেই সিসি ক্যামেরা ও মনিটরিং আছে। এখানে এই বিষয়গুলো এখন বলতে গেলে অসম্ভব।
তিনি বলেন, যা হয় তা হলো কোনো যাত্রী যে বিমানবন্দর থেকে ফ্লাই করেন সেখান থেকে চুরি হতে পারে। আবার কোনো যাত্রীর লাগেজে কন্ট্রাব্যান্ড কোনো আইটেম থাকতে পারে। তখন সেটাতো তালা মারা থাকলে ওই বিমানবন্দরে কেটে চেক করবে। আবার বক্স করা থাকলে তা ভাঙ্গা হয়।
তার কথা, তারপরও আমাদের কাছে তো অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগ না করলে আমরা ব্যবস্থা নেব কীভাবে? আমার আহ্বান যাত্রীদের কাছে তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে যেন আমাদের কাছে করেন। আমরা এটার একটা সমাধান করতে চাই। কিন্তু সেটা না করে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই পোস্ট দিয়ে তাদের লাগেজ চুরি বা কাটার কথা জানান।
সংশ্লিষ্টদের মতে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অন্তত অর্ধশত লাগেজ পার্টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আর তাদের অপকর্মে সহযোগিতা করছে বিমানবন্দরেই কর্মরত দুর্নীতিবাজ পুলিশ, কাস্টম ও সিভিল এভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। দীর্ঘদিন ধরেই বিমানবন্দরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়ার পরও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হচ্ছে না।
বিশেষ করে লাগেজ কাটা পার্টির দৌরাত্ম্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিমানবন্দরে লাগেজ চুরিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সক্রিয় রয়েছে। বছরের পর বছর এ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লাগেজ চুরির সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক বনে গেছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ