প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্মজ্বালানি পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। আর এগুলো থেকে যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ঘটে তা বিশ্বের উত্তপ্ত হয়ে ওঠার অন্যতম বড় কারণ। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অগ্নিকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে এবং সার্বিকভাবে মানবজাতি দীর্ঘমেয়াদি ও বিপর্যয়কর হুমকির মুখে পড়েছে। এ জন্যই পৃথিবী নামের এই গ্রহের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী মানবজাতির অস্তিত্বের স্বার্থে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করা অত্যন্ত জরুরি।
এই বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে এরই মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। যে কার্বন-ডাই অক্সাইড পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু, সেই ক্ষতিকর কার্বন-ডাই অক্সাইড থেকে বিশেষ বৈজ্ঞানিক উপায়ে এক ধরনের নির্মল জ্বালানি তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেছেন জার্মানির বিজ্ঞানীরা। এই পদ্ধতিতে কার্বন-ডাই অক্সাইডকে তাপে ও চাপে তরল হাইড্রোজেনে রূপান্তর করা হয়। এই তরল হাইড্রোজেন পরিবেশবান্ধব এবং তা থেকে ক্ষতিকর নিঃসরণ প্রায় হয় না বললেই চলে।
জার্মানির ড্রেসডেন শহরে একটি কোম্পানি এই ক্ষতিকর গ্যাস থেকে ‘ব্লু ক্রুড’ নামে তরল পদার্থ উৎপাদনের পথ খুঁজে পেয়েছে। এই ব্লু ক্রুড পরিশোধন করে তা থেকে পাওয়া যায় ‘ব্লু’ গ্যাস। ব্লু গ্যাসই হলো বর্তমান জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প। এই ব্লু গ্যাস বা হাউড্রোজেন দিয়ে গাড়ি চলছে বেশ ক’বছর ধরেই। এখন গবেষণা চলছে এটিকে বিমানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে। ‘ব্লু’ গ্যাস কিন্তু নীল নয়। এর নামকরণ হয়েছে এর আবিষ্কারক জার্মান বিজ্ঞানী হেরমান ব্লুর নাম অনুসারে।
ব্লু গ্যাস তথা সবুজ হাইড্রোজেন এখন বাস্তবায়নের পর্যায়ে আছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭০ সালের লরেন্স ডব্লিউ জোনসের টেকনিক্যাল রিপোর্টে যাকে বলা হয়েছিল ‘হাইড্রোজেন অর্থনীতি’, এখন সেই দিকে চলার লক্ষ্যে প্রায় ৩০টি দেশ (এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড–সহ) ও ক্যালিফর্নিয়া নানা কৌশল, ভিশন ডকুমেন্ট বা পথনকশা তৈরি করেছে।
জার্মানিতে বিশ্বের প্রথম হাইড্রোজেনচালিত ট্রেন
বিশ্বের প্রথম হাইড্রোজেন ইঞ্জিনচালিত পরিবেশবান্ধব ট্রেন চালু করে জার্মানি। ফ্রান্সের দ্রুতগতির ট্রেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যালস্টোম এই হাইড্রোজন ট্রেন বানিয়েছে। নীল রঙের এই ট্রেনের নাম কোরাডিয়া ইলিন্ট ট্রেন।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই হাইড্রোজেন ট্রেন প্রথম ছাড়া হয় জার্মানির লোয়ার সেক্সন রাজ্যের ব্রেমেরফুর্দে স্টেশন থেকে। জার্মানির কুক্সহ্যাভেন, ব্রেমারহেভেন, ব্রেমারভার্দে ও বুক্সেহুডে চলাচল করবে ট্রেন দুটি। জার্মানির কুক্সহেভেন ও বুক্সতেহুদে শহরের মধ্যে ১০০ কিলোমিটার রেলপথে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর ডিজেল ইঞ্জিন সরিয়ে হাইড্রোজেন ইঞ্জিন জুড়ে দেওয়া হয়।
অ্যালস্টোমের পক্ষ থেকে বলা হয়, একটি হাইড্রোজেন ট্যাংক ট্রেনের সঙ্গে আছে আর এর ছাদে আছে জ্বালানি কোষ। অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে শক্তি উৎপাদন করে। অতিরিক্ত জ্বালানি সংরক্ষণ করা হয় ব্যাটারিতে। একবার জ্বালানি নিয়ে ট্রেনটি এক হাজার কিলোমিটার চলতে পারবে। বিশ্বের প্রথম এই হাইড্রোজেন ট্রেনটি ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতে ছোটে। হাইড্রোজেন ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়ার পরিবর্তে বাষ্প বের করে। পরিবেশবান্ধব ট্রেনটি কোনো দূষণ নির্গমন করে না। এর শব্দদূষণ নেই বললেই চলে। ইঞ্জিনচালিত রেলগাড়িগুলোতে খরচও পড়বে কম।
দেশটির পুরোনো ডিজেলচালিত ইঞ্জিনগুলো সরিয়ে অত্যাধুনিক এই হাইড্রোজেন ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এটিই এখন পৃথিবীর নতুন পরিবহন প্রযুক্তি। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই ট্রেন দেশটির যোগাযোগ খাতে বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই বিশ্বাস জার্মান সরকারের। চলতি বছর আগস্ট মাসের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ফরাসি প্রতিষ্ঠান অ্যালস্টোম এমন ১৪টি ট্রেন প্রস্তুত করেছে। এই ট্রেনগুলো জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি প্রদেশে ব্যবহার করা হবে। ট্রেনগুলো প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে।
বর্তমানে জার্মানির মাত্র ২০ শতাংশ ট্রেন যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি প্রদেশের আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ পরিচালনাকারী সংস্থা এলএনভিজি জানিয়েছে, ওই ১৪ সেট ট্রেনের জন্য তাদের ব্যয় করতে হয়েছে ৯৩ মিলিয়ন ডলার। এবং এই ট্রেনগুলো প্রতিবছর বায়ুমণ্ডলে ৪ হাজার ৪০০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
কানাডার সঙ্গে জার্মানির হাইড্রোজেন চুক্তি
ট্রান্সআটলান্টিক হাইড্রোজেন সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে কানাডা ও জার্মানি। তিন বছরের মধ্যে সরবরাহ চালুর লক্ষ্য দেশ দুটির। উল্লেখ্য, বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষ ছয়টি দেশের মধ্যে কানাডা অন্যতম।
রাশিয়ার গ্যাসের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে জার্মানি। এ জন্য কানাডার দ্বারস্থ হয় দেশটি। এরপর নিউফাউন্ডল্যান্ডে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের এই চুক্তি হয়।
এই চুক্তি অনুসারে কানাডা থেকে জার্মানি গ্রিন হাইড্রোজেন কিনবে। অবিলম্বে অবশ্য গ্রিন হাইড্রোজেন পাওয়া যাবে না। কানাডা প্রথম ডেলিভারি দেবে তিন বছর পর। জার্মানির দুটি সংস্থার সঙ্গেও কানাডার কম্পানির চুক্তি হয়েছে।
কানাডায় অর্থনৈতিক শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেন জার্মান চ্যান্সেলর। সেখানে জাস্টিন ট্রুডোও ছিলেন। পরে তারা ওই চুক্তি করেন। চ্যান্সেলর হিসেবে ওলাফ শোলৎজ প্রথমবারের মতো কানাডায় গিয়ে রাশিয়ার ওপর থেকে গ্যাসসংক্রান্ত নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ওলাফ শোলৎজ বলেছেন, জার্মানি দ্রুত রাশিয়ার ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে চায়। সে জন্য তারা কানাডার দিকেও তাকিয়ে রয়েছে। শোলৎজ বলেছেন, জ্বালানির ক্ষেত্রে কানাডা সুপারপাওয়ার হতে পারে। সেই সুযোগ ও ক্ষমতা তাদের আছে।
শোলৎজ ও জাস্টিন ট্রুডো জানান, জার্মানি কানাডা থেকে লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি)-ও কিনতে চায়। অন্যদিকে জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, আমরা সম্ভাব্য সব রকমভাবে জার্মানিকে সাহায্য করতে চাই। আসন্ন শীতে ইউরোপ রীতিমতো সমস্যায় পড়বে। সে কারণে আরো বেশি করে চেষ্টা করছি তাদের সাহায্য করার।
পরিবহন খাতে বিপ্লব
হাইড্রোজেনকে জ্বালানিতে রূপান্তর করে পরিবহন খাতে ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। গত ২০১৫ সাল থেকে হাইড্রোজেন চালিত গাড়ি চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও আরো কয়েকটি উন্নত দেশের সড়কে। ওইসব দেশে পেট্রোলিয়াম রিফুয়েলিং স্টেশনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন। তবে তা খুবই ধীর গতিতে সীমিত আকারে চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি রাজ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ২০০টি হাইড্রোজেন স্টেশন ও দুই লাখ ৫০ হাজার চার্জিং স্টেশন নির্মাণে ৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি শহরে এখন সরকারিভাবে হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন আছে ৩৯টি। আরো ২৫টির নির্মাণকাজ চলছে। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সিসহ যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট কোস্টের রাজ্যগুলোও এগিয়ে আসছে। এর বাইরেও বিভিন্ন কোম্পানির বড় বড় ওয়্যারহাউজে এবং বিতরণ কেন্দ্রে হাজার হাজার হাইড্রোজেন চালিত মালামাল পরিবহনের ট্রাক (ফর্কলিফট) চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকগুলো শহরে এমন ব্লু গ্যাসচালিত বাস চালু আছে। কানাডার কুইবেক রাজ্যের রাজধানী মন্ট্রিলে হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন করার জন্য রাজ্যে সরকারের সাথে আলোচনা চালাচ্ছে গাড়ি তৈরির কোম্পানি টয়োটা ও হোন্ডা। এমনকি তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবেও শিগগিরই এ ধরনের স্টেশন হতে যাচ্ছে।
টয়োটাসহ বিশ্বের সব বড় বড় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ব্লু গ্যাসের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় বিস্তর টাকা ঢালছে। আর এসবই হচ্ছে বিশ্বের জলবায়ু তথা পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে। গত কয়েক বছর ধরে প্রচলিত গাড়িগুলোকে হাইব্রিড করা হচ্ছে জ্বালানি সাশ্রয়ী করতে যাতে জ্বালানি কম পোড়ে। ফলে দূষণও কম হয়। এরপর ‘ইলেকট্রিক কার’ আসছে। দূষণ কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন দেশ একটা করে টাইমফ্রেম ঘোষণা করছে। ওই সময়সীমার পর আর প্রচলিত তেলে চলা গাড়ি চলতে দেয়া হবে না।
এই সুযোগ নিতে চায় এলন মাস্কের তেসলা ও অন্য গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার ব্লু গ্যাস সম্ভবত বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে। বিশ্বে গাড়ি নির্মাতাদের মধ্যে এখন জোর বিতর্ক চলছে এই নিয়ে যে, ব্যাটারি-চালিত ইলেকট্র্রিক কার নাকি, হাইড্রোজেন থেকে উৎপাদিত ব্লু গ্যাস বা ফুয়েল সেল চালিত গাড়ি বিশ্বের ভবিষ্যৎ বাজার দখল করবে।
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্ময় এলন মাস্কের গাড়ি কোম্পানি তেসলা গাড়ির ভবিষ্যৎ বাজার দখলে মরিয়া। তারা ইলেকট্র্রিক কার তৈরির অন্যতম প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ এমন জল্পনা উসকে দিচ্ছেন যে, ব্লু গ্যাস তেসলাকেও শেষ পর্যন্ত ধসিয়ে দিতে পারে। ব্লু গ্যাসনির্ভর গাড়িকে বলা হচ্ছে ‘ফুয়েল সেল ইলেকট্র্রিক ভেহিকেল’। বলা হচ্ছে, এটি জ্বালানি ট্যাঙ্কে হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেনের সংশ্লেষ ঘটিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এবং তাতেই গাড়ি চলে। এতে সামান্য জলীয়বাষ্প নিঃসরিত হয় মাত্র। কোনো বায়ুদূষণ ঘটে না। একবার ট্যাঙ্ক ভরে নিলে গাড়িটি ৩০০ মাইল চলতে পারবে। সেই সাথে এই গাড়িতে বর্তমান গাড়ির মতোই অতি দ্রুত গতি পাওয়া যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ