২০৫০ সাল নাগাদ সরকার ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হাইড্রোজেনভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা স্থাপন করতে চায়। কিন্তু এই পরিকল্পনা দেশের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রার বিরুদ্ধে চলে যাবে—এমনটা জানা গেছে নতুন এক গবেষণায়। গবেষণায় উঠে এসেছে, ব্লু হাইড্রোজেন দূষিত গ্যাস নিঃসরণের দিক থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়েও ক্ষতিকর।
গত বছর বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎবিষয়ক সমন্বিত মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি-২০২৩) উন্মুক্ত করেছে। এটি হয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সি ও জাপানের ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকসের সহায়তায়। এতে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে এক লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে, যার মধ্যে ২২ হাজার ৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে হাইড্রোজেন জ্বালানি থেকে।
উৎপাদন প্রক্রিয়ার দিক থেকে হাইড্রোজেন জ্বালানি হয় তিন প্রকারের—গ্রে, ব্লু ও গ্রিন। এরমধ্যে গ্রে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। গ্রিন হাইড্রোজেনই সবচেয়ে বেশি পরিবেশসম্মত, যা বায়ু বা সৌরবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎশক্তি দিয়ে উৎপাদন করা হয়। এতে কোনো প্রকার গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হয় না।
অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানিকে ব্লু হাইড্রোজেন উৎপাদনে কাজে লাগানো হয়। তবে এখানে কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ পদ্ধতিতে নিঃসৃত গ্রিনহাউজ গ্যাস আংশিকভাবে শোষণ ও তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে।
একেও অনেকসময় পরিবেশসম্মত জ্বালানি দাবি করা হয়। তবে নতুন গবেষণাটি বলছে, পরিবেশের জন্য প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়েও ক্ষতিকর হতে পারে ব্লু হাইড্রোজেন।
আইইপিএমপি-২০২৩-এর
লক্ষ্যমাত্রায় গ্রিন নাকি ব্লু হাইড্রোজেন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। তবে গ্রিন হাউড্রোজেনের চেয়ে তুলনামূলক কম খরচের হওয়ায় বিদ্যুতের বেশিরভাগটাই ব্লু হাইড্রোজেন থেকে উৎপাদন করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্লু হাইড্রোজেন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মিথেন গ্যাসের আণবিক গঠন ভেঙে হাইড্রোজেন আলাদা করা হয়। আর নিঃসৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে কার্বন ক্যাপচার ও স্টোরেজ প্রযুক্তির সহায়তায় বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণের পর তা সংরক্ষণ করা হয়। এর মাধ্যমে পরিবেশ নিরাপদ থাকে বলে দাবি করা হয়। তবে এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ড (ইডিএফ)-এর গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।
অন্যদিকে, পানির আণবিক গঠন ভেঙে তা থেকে হাইড্রোজেন আলাদা করতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদনে। গবেষকদের মতে, এ প্রযুক্তিতে আরো বিনিয়োগ দরকার, তবে এর কাঁচামাল সহজে পাওয়া যায়।
সে তুলনায় স্থানীয়ভাবে উত্তোলন করা বা আমদানি করা মিথেন গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হবে ব্লু হাইড্রোজেন উৎপাদন। তবে গ্রিন বা ব্লু যেটিই হোক, হাইড্রোজেন উৎপাদনে দরকার হবে বহু নতুন প্রযুক্তির। এসব প্রযুক্তি জাপান বা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। জাপানের ব্লু হাইড্রোজেন উৎপাদন প্ল্যান্ট রয়েছে। কিন্তু এসব প্রযুক্তি আমদানিতে বিপুল ব্যয় করতে হবে।
এত বিনিয়োগের পরেও পরিবেশ যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী দূষণমুক্ত না থাকে, তাহলে অর্থনীতিসহ সবদিক দিয়েই ব্লু হাইড্রোজেন শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য বোঝায় পরিণত হবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত মাসে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জার্নালে। সেখানে ইডিএফ ফান্ডের গবেষকরা বলেছেন, জলবায়ুর ওপর প্রচলিত জ্বালানির চেয়েও ব্লু হাইড্রোজনের প্রভাব ৫০ শতাংশ বেশি ক্ষতিকর হবে।
ইডিএফ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক পরিবেশবাদী সংগঠন। তাদের গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে গত ২১ ফেব্রুয়ারি। গবেষণা নিবন্ধে ব্লু হাইড্রোজেনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আলোকপাত করে জানানো হয়েছে, এর সরবরাহ শৃঙ্খল বা ব্লু হাইড্রোজেনের উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবহার পর্যন্ত উচ্চ মাত্রায় হাইড্রোজেন ও মিথেন নিঃসরণ হতে পারে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় স্বল্পমেয়াদি বা নিকট ভবিষ্যতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে তুলবে।
এতে আরো বলা হয়, ব্লু হাইড্রোজেন উৎপাদন ও ব্যবহারের সমর্থকরা কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তিকে তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। তারা বলছেন, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বায়ুমণ্ডলে যাওয়া থেকে আটকানো যাবে। অথচ নিয়মিত এই হারে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ আটকাতে পারবে, এখন পর্যন্ত এমন প্রযুক্তি বাজারেই আনা যায়নি।
এই ৯৮ শতাংশের বদলে যদি কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি কিছুটা কম, অর্থাৎ ৬০ শতাংশও কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকাতে পারে, তাতে ব্লু হাইড্রোজেনের কারণে পরিবেশের যতটা লাভ হবে বলে দাবি করা হচ্ছে, স্বল্পমেয়াদে তার চেয়ে ১৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত আর দীর্ঘমেয়াদে ২০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কম লাভ হতে পারে।
ইডিএফের গবেষণা নিবন্ধের মূল লেখক তিয়ানি সান বলেন, ‘জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের ফলে জলবায়ুর ওপর কী কী প্রভাব পড়বে, এবং সেসব প্রভাব কমাতে কী কী সুযোগ কাজে লাগানো যায়, তা খুঁজে পেতে—উভয় ক্ষেত্রেই নিঃসরণের পরিমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বের করা দরকার।
‘জলবায়ুর ওপর (গ্রিনহাউজ গ্যাস) নিঃসরণের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের সবকিছু বিবেচনায় নেওয়ার পর আমাদের পর্যালোচনা দেখাচ্ছে, জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের প্রভাব আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক অনেক বেশি।’
‘পরিচ্ছন্ন’ বা দূষণমুক্তভাবে উৎপাদিত হাইড্রোজেনের সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা গ্রিন হাইড্রোজনই হলো পরিচ্ছন্ন হাইড্রোজেন।
কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনে হাইড্রোজেন উৎপাদনের নিঃসরণ মাপার বৈশ্বিক একটি আইএসও পদ্ধতি ঘোষণা করা হয়। তবে এতে ব্লু হাইড্রোজেনের নিঃসরণের পরিমাণ কম ধরা পড়বে, এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেন পরিবেশবিদরা।
বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎবিষয়ক সমন্বিত মহাপরিকল্পনায় ব্লু হাইড্রোজনকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বেশকিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ তাদের উদ্বেগের কথা বলেছেন।
জলবায়ু ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, ‘জ্বালানি ও বিদ্যুতের জন্য ব্লু হাইড্রোজেনের মতো অপ্রমাণিত উৎসের ওপর গুরুত্ব স্থানান্তরিত করলে তা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, ক্রয় -সক্ষমতা এবং জ্বালানি সংকটের দিক দিয়ে বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক বোঝা হয়ে উঠবে।’
‘সরকারের উচিত ব্লু হাইড্রোজেন ব্যবহারের এই পরিল্পনা থেকে সরে আসা। এর পরিবর্তে সত্যিকার অর্থে দূষণমুক্ত গ্রিন হাইড্রোজেনকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হবে,’ তিনি যোগ করেন।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট-এর সদস্য সচিব হাসান মেহেদী টিবিএসকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন প্রযুক্তি নিঃসরণ হ্রাসের জন্য মিথ্যা সমাধান হিসেবে পরিচিত, কারণ প্রযুক্তিটি যথেষ্ট প্রমাণিত নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোও গত বছর জি৭ সম্মেলনের সময় জাপানের কাছ থেকে এ প্রযুক্তি গ্রহণের প্রত্যাখ্যান করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বিবেচনা করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এ ধরনের অপ্রমাণিত প্রযুক্তি গ্রহণ করা উচিত নয়।’
আপনার মতামত জানানঃ