জ্বালানি খাতে পেট্রোবাংলা আশঙ্কাজনক হারে লোকসান দিতে শুরু করেছে। গত আগস্ট মাসে যেখানে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৩২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, সেখানে সেপ্টেম্বরে এসে লোকসান দিয়েছে ১০৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে পরিচালন মুনাফা কমেছে ৭১ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা শতকরা হিসাবে ৪১৬ শতাংশ।
আগের মাসের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা কমেছে তিতাসের, যা ২৭৯ শতাংশ। আর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির পরিচালন মুনাফা কমেছে ১৯৬ শতাংশ। পেট্রোবাংলার মাসিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জ্বালানি খাতে বিদেশ নির্ভরশীলতা বেড়ে যাচ্ছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বেশি দরে গ্যাস কেনা হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চ দরে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। সবমিলেই সামগ্রিক লোকসান বেড়ে যাচ্ছে। আর এ লোকসান সমন্বয় করতে বাড়াতে হচ্ছে গ্যাসের দাম। যা প্রকারন্তে সাধারণ গ্রাহকের ঘাড়েই চাপছে।
পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্টে গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদি বিক্রি করে পেট্রোবাংলার আয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। বিপরীতে ওই মাসে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা।
এতে আগস্টে পেট্রোবাংলার নিট পরিচালন মুনাফা হয়েছিল প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু সেপ্টেম্বরে এ আয় ব্যয়ের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা দেয়। যেমন, সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। বিপরীতে ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।
এতে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে ব্যয় ও আয়ের মধ্যে পার্থক্য হয় প্রায় ১০৪ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এক মাসের ব্যবধানে বিক্রয়বাবদ আয় কমেছে প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা। আর এর প্রভাব পড়েছে নিট আয়ে।
পেট্রোবাংলার লোকসান বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে বেশি হারে গ্যাস উত্তোলন করা হতো। কিন্তু এখন দিন দিন এ চিত্র পাল্টে বিপরীত চিত্র ধারণ করেছে। এখন বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ৬৩ শতাংশ গ্যাস কেনা হচ্ছে।
আর দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস কেনা হচ্ছে মাত্র ৩৭ শতাংশ। আবার দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে যে দামে গ্যাস কেনা হচ্ছে, বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস কিনতে তার তিনগুণ ব্যয় করতে হচ্ছে। আর এ কারণেই সামগ্রিক লোকসান দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪৯ কোটি ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। এর মধ্যে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কেনা হয় ২১০ কোটি ৩৫ লাখ ঘনফুট। আর বিদেশী কোম্পানিগুলো গ্যাস উৎপাদন করে প্রায় ৩৩৯ কোটি ঘনফুট।
এতে দেখা যায় বিদেশী কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদন করে ৬২ শতাংশ। তেমনিভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশী কোম্পানিগুলো গ্যাস উৎপাদন করে ৬৩ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ৫৭২ কোটি ৪৪ লাখ ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭৬৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
প্রতি কোটি ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৭ লাখ টাকা। অপর দিকে একই বছরে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ১৩২ কোটি ৩৭ লাখ ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয়েছে ৫২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। প্রতি কোটি ঘনফুট গ্যাস কিনতে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশীয় কোম্পানিগুলোর যে হারে সক্ষমতা বাড়ানোর কথা ছিল তা করা হচ্ছে না। নতুন নতুন কূপ খননে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে না। বলা যায়, অর্থসঙ্কটে দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের গ্যাস উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়াতে পারছে না।
অথচ দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি বছরই এলএনজির আমদানি বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। অন্য দিকে বিশ্ববাজারে আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতে এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ও বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে ভর্তুকি।
আর এ ভর্তুকির দায় চাপছে সাধারণ গ্রাহকের ওপর। গত বছরে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল প্রায় ২০০ শতাংশ। আর গত মঙ্গলবার বিদ্যুৎ ও ক্যাপটিভ পাওয়ারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৭৫ পয়সা। এভাবে লোকসানের দায় প্রকারন্তরে জনগণের ঘাড়েই চাপছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দেশীয় কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো প্রয়োজন। আর এ কারণে দক্ষ লোকবল ধরে রাখাসহ এ খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আপনার মতামত জানানঃ