রাজধানীতে বেড়েছে ফিটনেসবিহীন ও লক্করঝক্কর গাড়ির সংখ্যা। এসব গাড়িতে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বিআরটিএ দফায় দফায় নোটিশ দেয়ার পরও মালিকরা গাড়ির ফিটনেস হালনাগাদ করছেন না বলে জানিয়েছে। মাঝে মাঝে বিআরটিএর অভিযান চালালেও সড়কে এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়নি।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের সংখ্যা কত এবং তার মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কত—এর সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই কারও কাছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দাবি, সারা দেশে তাদের নিবন্ধিত বৈধ যানবাহনের সংখ্যা ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৬০টি। এরমধ্যে সাড়ে ৫ লাখের বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে।
বিআরটিএ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব বলছে, দেশে নিবন্ধিত যে ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৬০টি যানবাহনের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্তত সাড়ে ৫ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফিটনেস পরীক্ষা না করায় প্রক্রিয়াটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিআরটিএ’র তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২৫২টি যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। সেই হিসাবে গত সাত মাসে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫৬২টি করে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। তবে ফিটনেসবিহীন গাড়ির কোনও পরিসংখ্যান নেই সংস্থাটির কাছে।
বুয়েটের একটি সূত্র বলছে, ইঞ্জিনচালিত ভেহিক্যালের মধ্যে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল রয়েছে ৩৫ লাখের বেশি। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া রয়েছে আরও ১৫ লাখের মতো। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যাটা ৪০-৫০ লাখের কাছাকাছি এবং স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি নসিমন-করিমনের মতো গাড়ির সংখ্যাও ১০ লাখের মতো হতে পারে। এসব যানবাহনের মধ্যে বেশিরভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ফিটনেস সনদ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩ লাখ ৩৪ হাজার ২৫২টি যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। সেই হিসাবে গত সাত মাসে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ৫৬২টি করে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, এক লাখ ১০ হাজারের মতো বাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ৪ লাখের কাছাকাছি হবে। পিকআপের সংখ্যা ৭-৮ লাখের মতো। এরমধ্যে ফিটনেসবিহীন বাস ২০ শতাংশ, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ২০-২৫ শতাংশ, পিকআপের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হতে পারে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হিউম্যান হলারের ৮০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। ৪০ লাখের মতো মোটররিকশাকে আনফিট বলা যায়।
সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ যানবাহনের ফিটনেসহীনতা। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এমন ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা। এসব ফিটনেসবিহীন গাড়ির মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ছে। প্রায় প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। সংগত কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রতিরোধে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আনফিট বা ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। উদ্বেগের বিষয়, দীর্ঘদিন থেকে ফিটনেসের বিষয়টি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হলেও কার্যত যে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কোথাও ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটক করে তার লাইসেন্স বা রোড পারমিট বাতিল করা হয়েছে, মালিকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় বা তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, গাড়ি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলাভার। এমনকি কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় ন্যায়বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও বলা যায় পাওয়া দায়। বরং উল্টো অভিযোগ রয়েছে, ফিটনেস না থাকলেও বহু গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট পেয়ে যায়। চোখের দেখাতেই দিয়ে দেওয়া হয় ফিটনেস সার্টিফিকেট। চালকরা সহজেই পেয়ে যান ড্রাইভিং লাইসেন্স। কে কাকে ঠেকায়? কীভাবে ঠেকায়? সড়কে প্রচ- দাপটে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি চললেও তা দেখার যেন কেউ নেই, কর্তৃপক্ষ যেন দেখেও না দেখার ভান করে। এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে চলাচলের জন্য যেকোনও ভেহিক্যালের যান্ত্রিক ও কাঠামোগত ফিটনেস থাকতে হয়। কাঠামোগত দিকটি চোখে দেখে দেওয়া গেলেও যান্ত্রিক দিক পুরোপুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি দেখভাল করার মতো প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সক্ষমতা এই মুহূর্তে বিআরটিএ’র নেই। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির আন্তরিকতার অভাবের পাশাপাশি লোকবল সংকটও রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ফিটনেসবিহীন গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান জোরদার করে পুলিশ ও বিএরটিএ। তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সড়কে ফেরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সড়কে চলাচলকারী বেশিরভাগ যানবাহনের মালিক প্রভাবশালী। এদের অনেকে রাজনীতি করেন। এসব প্রভাবশালী ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন করেন না। অভিযান চালালে ধর্মঘটের হুমকি দেন। ফলে ঠিকমতো অভিযানও হয় না। দফায় দফায় মালিকপক্ষের সঙ্গে পুলিশ ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চালানোর আশ্বাস দেওয়া হলেও পরে মানেন না মালিক-চালকরা। উল্টো অভিযান চালালে প্রভাবশালীরা তদবির করে গাড়ি ছাড়িয়ে নেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৯
আপনার মতামত জানানঃ