ইন্টারনেট সুবিধাসহ প্রযুক্তির নানামাত্রিক ব্যবহার যতোই সহজলভ্য হচ্ছে ততোই সাইবার জগতে নারীদের সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানির ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। একইসাথে অনলাইনে হয়রানির শিকার হলেও আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না অধিকাংশ ভুক্তভোগী নারী।
পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডব্লিউ) ইউনিটে আসা ২২ মাসের (নভেম্বর ২০২০ থেকে আগস্ট ২০২২) তথ্য-উপাত্ত বলছে, ভুক্তভোগী নারীদের মাত্র ১২ শতাংশ মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
অর্থাৎ ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। এমনকি ৩২ শতাংশ ভুক্তভোগী পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তাদের কাছে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জানাতেও অস্বীকৃতি জানান। ভুক্তভোগীরা আইনিব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি বন্ধ বা আধেয় (কনটেন্ট) মুছে ফেলতেই বেশি আগ্রহী।
এর কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী অনেকে পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তাদের বলছেন, পরিবারকে জানাতে না চাওয়া ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে তারা বিষয়টি গোপন রাখতে চান। অনেক অভিযুক্তের সঙ্গে ভুক্তভোগীর পারিবারিক বন্ধনও থাকে। আবার পরবর্তী সময়ে হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায়ও অনেকে ওই পথে যেতে চান না।
পিসিএসডব্লিউ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর। যাত্রা শুরুর পর থেকে গত প্রায় ২২ মাসে অনলাইনে হয়রানির শিকার ২০ হাজার ১৫৬ নারী সেখান থেকে সহায়তা পেয়েছেন।
৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। এমনকি ৩২ শতাংশ ভুক্তভোগী পিসিএসডব্লিউর কর্মকর্তাদের কাছে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জানাতেও অস্বীকৃতি জানান।
পিসিএসডব্লিউতে অভিযোগকারী নারীদের ৪৪ শতাংশের অভিযোগ, ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে তাদের আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা তথ্য ছড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। ফেসবুক আইডি হ্যাক করে আপত্তিকর ছবি ও তথ্য ছড়িয়ে হয়রানি করার অভিযোগ ১২ শতাংশের। আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা তথ্য ইন্টারনেটে ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করার অভিযোগ ১৭ শতাংশ নারীর।
পিসিএসডব্লিউ বলছে, অভিযোগকারীদের একটি বড় অংশই (১৭ শতাংশ) ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। পূর্বপরিচয় বা অন্য কোনোভাবে পাওয়া ছবি, ভিডিও পাঠিয়ে টাকা দাবি করে অনেক অপরাধী। আবার অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতেও অনেককে ব্ল্যাকমেল করা হয়।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২২’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে যারা অনলাইন অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তাদের মধ্যে নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি হয়রানি ও পর্নোগ্রাফির শিকার হচ্ছেন। ৭৬ শতাংশ ভুক্তভোগী নারী আইনি সহায়তা নিতে চান না।
পুলিশ সদর দপ্তরের আড়ি পাতা (এলআইসি) শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মীর আবু তৌহিদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দেশের যেকোনো জায়গা থেকে পিসিএসডব্লিউতে অভিযোগ দেওয়া যায়। অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনার সত্যতা যাচাই করা হয়। তথ্যপ্রমাণ পেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা আইনি প্রতিকার চান না। এ কারণে অনেক সময় ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনলাইনে নারীদের একটি বড় অংশই পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন। তাদের মধ্যে নিকটাত্মীয়ও থাকেন। অনেক সময় অভিযুক্তকে দোষারোপ না করে ভুক্তভোগীকেই দোষ দেওয়া হয়। আবার ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই বয়সে কিশোরী ও তরুণী। তারা বিষয়গুলো বাবা-মাকেও জানাতে চান না। কখনো দেখা যায়, অভিযুক্তরা প্রভাবশালী। সামাজিক মর্যাদা ও ভবিষ্যতে হয়রানির ভয়ও আছে নারীদের। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীরা আইনি পদক্ষেপ নিতে চান না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পারিবারিক বা সামাজিক কারণে ভিকটিম নারীদের ফেক আইডি বা কন্টেন্ট ডিলিটের মাধ্যমে আপসে খুশি না হয়ে আইনগতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে সাইবার অপরাধীরা বেপরোয়া হতে পারবে না। এতে করে নারীদের সাইবার হয়রানির সংখ্যাও অনেক কমে আসবে।
তারা বলেন, বাংলাদেশে খুব সহজে নারীদের হয়রানি করা যায়। এসব নিয়ে ভুক্তভোগী নারীদের মধ্যে সঠিক উপায়ে প্রমাণাদি রাখার প্রবণতা কম। ঘটনার পর প্রত্যেকের উচিত রিপোর্ট করা। টিকটক বা লাইভ ভিডিওভিত্তিক বিনোদনের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু যদি সেটা অপরাধ প্রবণতাকে উস্কে দেয় তাহলে তা এড়িয়ে যেতে হবে। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এসব অভ্যাস এখন মানসিক অশান্তির কারণ হিয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা আরও বলেন, টিকটকের মতো বিষয়গুলোকে মানুষ এখন অন্ধভাবে অনুসরণ করছে, যা মোটেই উচিত নয়। এসব সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সোচ্চার হলেও প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের নিজেদের সচেতনতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধু বেছে নেবার ক্ষেত্রেও নিজেকে এবং পরিবারকে সচেতন হতে হবে। পরিচিত ব্যক্তির থেকে নারীরা সহিংসতার শিকার হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকাশ করে না। এই ট্রমা থেকে সারাজীবন রক্ত ঝরে। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হলে সবার আগে সবচেয়ে কাছের মানুষ কিংবা পরিবারকে জানাতে হবে। সাহস নিয়ে মানুষগুলোর মুখোশ খুলতে হবে।
তারা বলেন, প্রায় দেখা যায়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার ব্যক্তি জনসম্মুখে নিজেকে প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন। তা না করে বরং প্রতিটি সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সাবলীলভাবে উত্তর দিন। এখানে যেহেতু আপনি কোন দোষ করেননি সেহেতু নিজেকে লুকিয়ে রাখার কোন অর্থ নেই। বরং আপনার ইতিবাচক সাড়া অপরাধ ও অপরাধীর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে ইন্ধন যোগাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৮
আপনার মতামত জানানঃ