অ্যাকশনএইডের ‘বাংলাদেশে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৬৩.৫১ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন৷ আগের বছরের তুলনায় যা ১৪ শতাংশ বেশি৷ এরমধ্যে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তারা৷ এই হার ৪৭ শতাংশ৷ মেসেঞ্জারে হারটি ৩৫ শতাংশ৷ এছাড়া ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ অন্যান্য মাধ্যমেও সহিংসতার মুখে পড়েছেন নারীরা৷ গত ১১ থেকে ১৮ নভেম্বর ৫১৪ অনলাইন ব্যবহারকারী নারী তাদের এই গবেষণা জরিপে অংশ নেন৷
গবেষণায় বলা হয়, অনলাইনে নারীরা ১২ ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন৷ সবচেয়ে বেশি ৮০ শতাংশ নারী অশ্লীল, ক্ষতিকর, যৌনতামূলক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য পেয়ে থাকেন৷ ৫৩ শতাংশ নারীকে ইনবক্সে অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে যৌন সম্পর্ক করার কথা বলে হয়রানি করা হয়৷ বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন ১৯ শতাংশ নারী৷ সামাজিক মাধ্যমে নারীদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া আইডি খোলার মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হয়েছেন প্রায় ১৮ শতাংশ নারী৷ ১৬ শতাংশ নারী বলেছেন, সাইবার জগতে তাদের কর্মকান্ড সব সময় অনুসরণ করা হচ্ছে৷
২০২১ ও ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে অ্যাকশনএইড বলছে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানোর হার খুবই কম, মাত্র ১৫ শতাংশ৷ যারা অভিযাগ করেছেন তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা প্রতিকার পাননি৷ আর যারা হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হন তাতের মধ্যে কিশোরীও রয়েছেন৷
পাঁচ বছর ধরে হয়রানি
ঢাকায় বসবাসরত এক তরুণীর ২০১৫ সালে বিয়ে হয়৷ বিয়ের পর শুধু ওই তরুণী নয়, তার পুরো পরিবার অনলাইন, বিশেষ করে ফেসবুকে হয়রানির শিকার হন৷ তাতে ওই তরুণীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল৷
তার ভাই জানান, ‘‘২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে এই হয়রানি অব্যাহত ছিল৷ পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর ২০২১ সাল থেকে হয়রানি বন্ধ হয়৷ কিন্তু অপরাধীকে চিহ্নিত বা গ্রেপ্তার করা যায়নি৷”
তিনি জানান, ‘‘আমার বোনের বিয়ের পর একটার পর একটা ফেক ফেসবুক আইডি খুলে আমার বোন সম্পর্কে অশ্লীল কথা লিখে পোস্ট দেয়া হতো৷ আর সেটা তার স্বামীর ইনবক্সেও পাঠানো হতো৷ এখানেই শেষ নয়, আমাদের পরিবারে সদস্যদের ইনবক্সেও পাঠানো হতো৷ বলা হতো তার কাছে অনেক ভিডিও এবং ছবি আছে, যা সে প্রকাশ করবে৷ হুমকি দিত৷ এক পর্যায়ে আমরা পুরো পরিবারই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি৷ আমার বোনকে তার স্বামীও ভুল বুঝতে শুরু করেন৷ দূরত্ব তৈরি হয়৷”
তিনি বলেন, ‘‘কোনো উপায় না দেখে ২০২১ সালের প্রথম দিকে আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করি৷ এরপর থেকে ওই অজ্ঞাত ব্যক্তির তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়৷ তবে তাকে গ্রেপ্তার বা চিহ্নিত করার কোনো খবর পুলিশ আমাদের দেয়নি৷”
তার কথা, ‘‘পাঁচটি বছর আমার বোনসহ আমাদের পুরো পরিবারের সদস্যরা এক বিভীষিকার মধ্যে ছিলাম৷ আমরা আতঙ্কে থাকতাম, কখন অশ্লীল পোস্ট দেয়, মেসেজ পাঠায়৷ আমাদের পরিবারের স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ সেই কথা মনে পড়লে এখনো আমরা আঁতকে উঠি৷ আমার বোনটি এখন মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে৷”
আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন কেউ কেউ
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী এখন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত৷ তিনি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ নানা মাধ্যমে এখন হয়রানির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন৷ তার ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে সেটাই বিকৃত করে তার নামেই ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে হয়ররানি করা হচ্ছে৷
তিনি জানান, ‘‘তারা আমার ছবি ও ভিডিও নিয়ে বিকৃত করে প্রচার করছে৷ প্রথম প্রথম এটা নিয়ে আমি খুব ডিপ্রেশনে থাকতাম৷ পরে মেনে নিয়েছি৷ আমার এখন ভাবনা, আমি যেহেতু মিডিয়ায় কাজ করি তাই আমাকে নিয়ে এরকম হতেই পারে৷ আমি এখন আর পাত্তা দেই না৷”
‘‘তবে ভয়াবহ ব্যাপার হলো হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে নানা অশ্লীল প্রস্তাব করা হয়, বাজে মন্তব্য করা হয়৷ এনিয়ে আমি একবার পুলিশের শরণাপন্নও হই৷ কিন্তু প্রতিকার পাইনি৷ আরেকবার তারা আমার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সেখানে আমার ছবি বিকৃত করে নানা অশ্লীল ছবি দিয়েছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমি না হয় সামলে নিয়েছি৷ কিন্তু আমার পরিচিত অনেকেই পারছেন না৷ এ নিয়ে আমার পরিচিতদের মধ্যে সুইসাইডের মতো ঘটনাও ঘটেতে যাচ্ছিল৷ একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগডেতে নাচার ছবি ও ভিডিও নিয়ে অশ্লীল প্রচারও চলানো হয়৷”
সংবাদমাধ্যমে এই রকম হয়রানির পর আত্মহত্যার খবর প্রায়ই দেখা যায়৷ গত ২২ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলে এক কলেজ ছাত্রীর আপত্তিকর ভিডিও ফেসবুকে আপ করে দেয়ার পর সেই তরুণী আত্মহত্যা করেন৷ গত ৭ জুলাই সাতক্ষীরায় একই ধরনের ঘটনায় এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷
বিশেষজ্ঞের মতামত
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘‘আমরা তো সাইবার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারব না৷ তাই আমাদের অনলাইন লিটারেসি বাড়াতে হবে৷ বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের সতর্কতাগুলো বুঝতে হবে৷ আর এটার যে প্রতিকার পাওয়ার উপায় আছে তাও সবাইকে জানাতে হবে৷ কোনো লজ্জার কারণে ভয়ে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকা নয়, সাহস নিয়ে অভিযোগ করতে হবে৷ আর সামাজে এই অপরাধ সম্পর্কে সচেতন করতে ব্যাপক কাম্পেইন করতে হবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং হয়রানি বাড়ছে৷ সরকার সাইবার ক্রাইম ইউনিট এবং অভিযোগের জন্য হটলাইন চালু করেছে৷ কিন্তু যারা এই অপরাধ নিয়ে কাজ করেন সেই পুলিশ সদস্যদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন৷ কারণ অধিকাংশ হয়রানি করা হয় ফেক আইডি থেকে৷ তাই অপরাধীকে চিহ্নিত করার জন্য দক্ষতা ও সাইবার জ্ঞান জরুরি৷”
ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার হুমায়রা পারভীন বলেন, ‘‘অভিযোগ না করার অনেক সামাজিক কারণ থাকতে পারে৷ কেউ হয়ত লজ্জার ভয়ে অভিযোগ করেন না৷ কিন্তু সাইবার ক্রাইম ইউনিট এটা নিয়ে কাজ করছে, অভিযোগ নিচ্ছে৷ অভিযোগ করলে পুলিশ অবশ্যই প্রতিকারের ব্যবস্থা করে৷ অভিযোগ করতে হবে৷”
এসডব্লিউএসএস১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ