পাকিস্তানে গুম ও জোরপূর্বক অপহরণের বিষয়টি অনেক পুরনো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এই নির্মম গুম-অপহরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণাধীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
ক্ষমতাসীনদের তালিকা ধরে বেছে বেছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক গুম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। এ কাজ করে আসছে দেশটির সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
বিরোধী মতের মানুষকে গুম করে ফেলার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানে বিতর্ক চলছে৷ দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সন্দেহের আঙুল তুলছেন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার দিকে৷
পাকিস্তান সরকার ২০১১ সালে কমশন অব ইনকোয়ারি অ্যান্ড এনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স নামে একটি সংস্থা গঠন করে৷
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাসে সারাদেশে ৮ হাজার ৬৯৬টি নিখোঁজের ঘটনা ঘটে৷ এরমধ্যে ৬ হাজার ৫১৩টি ঘটনার সমাধান করা হয়েছে আর বাকী ২ হাজার ২১৯টি ঘটনার তদন্ত চলছে৷
ইসলামাবাদে কর্মরত পাকিস্তানি সাংবাদিক গওহর মেহসুদের মতে, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে দেওয়া সরকারের যে তথ্য তার তুলনায় প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি৷
তার মতে, কমিশন অব ইনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসএপিয়ারেন্স ২০১১ সালে গঠিত হয়৷ কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার এমন ঘটনা তারও এক দশক আগে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে হয়ে আসছে৷
তাছাড়া বালোচিস্তান, খাইবার পাখতুন ওবং সিন্ধ প্রদেশের মানুষেরা নিখোঁজের বিষয়ে সবসময় কমিশনকে তথ্যও দিতে পারেন না৷
এদিকে দেশে নিখোঁজ হওয়া লোকের সংখ্যার বিষয়ে আলাদা আলাদা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে৷ পশতুন প্রদেশের পশতুন তাগাফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম) নামে একটি সংগঠনের দাবি, এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার পশতুন নিখোঁজ রয়েছেন৷
আর ভয়েস অব বালোচ ফর মিসিং পার্সনস নামের আরেকটি সংগঠনের দাবি, বালোচিস্তানের নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তির সংখ্যা ছয় হাজার পাঁচশ৷
এদিকে ২০১৯ সালে বালোচিস্তান সরকার এবং ভয়েস অব বালোচ ফর মিসিং পার্সন নামের সংগঠনটি একটি চুক্তি সই করে৷ চুক্তি অনুযায়ী, বেসরকারি সংস্থাগুলো নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে৷ এরপর থেকে সংগঠনটি সরকারকে নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে৷
সংগঠনটির চেয়ারম্যান নসরুল্লাহ বালোচ বলেন, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বালোচ ছাত্রছাত্রীদের উপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে৷ কয়েক মাস আগে করাচি বিশ্ববিদ্যারয়ের এক বালোচ নারী আত্মঘাতী হামলে করলে সারাদেশে বালোচ জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন শুরু হয়৷ ‘‘এরপর থেকে দেশজুড়ে প্রায় তিনশ বালোচ শিক্ষার্থীকে গুম করা হয়েছে,” দাবি তার৷
মানবাধিকার কর্মী ইমরান বালোচ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘গত কয়েক মাস বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা বালোচ জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাঝে বিশেষ করে নিরীহ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে৷’
পাকিস্তানের গণ্যমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের শুরু থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে বালোচিস্তান এবং দেশটির বিভিন্ন শহর থেকে অন্তত ৪৮ বেলুচ শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছেন। তবে অধিকার সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ভয়েস অব বালোচ মিসিং পারসনসের (ভিবিএমপি) দাবি, নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, নিখোঁজ অনেক তরুণের পরিবারকে মুখ না খোলার ব্যাপারে হুমকিও দেওয়া হয়।
গত কয়েক মাস বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা বালোচ জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মাঝে বিশেষ করে নিরীহ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে৷’
দেশটির গণ্যমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতে ৭টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৮, মার্চে ৮, এপ্রিলে ৬ এবং মে মাসে ১৯ জন অপহরণের শিকার হন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, সম্প্রতি ৩ হাজার বালোচ নাগরিক গুম হয়েছে পাক বাহিনীর হাতে। তদন্ত কমিশন ৭ হাজারটি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা খুঁজে পেয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৫ হাজারটি ২০২১ সালের মধ্যে পরিচালনা করা হয়েছে। পাকিস্তানে জোরপূর্বক গুমের অনুশীলন শুরু হয়েছিল মোশাররফ প্রশাসনের সময় (১৯৯৯-২০০৮), কিন্তু এটি পরবর্তী সরকারের অধীনে অব্যাহত রয়েছে।
থিঙ্ক ট্যাঙ্কের মতে, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা হয়রানি, হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নির্যাতন বালোচ জনগণকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। পাকিস্তানে বালোচ জনগণ বেদনা ও যন্ত্রণার মাঝে জীবন অতিবাহিত করছে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়্যারম্যান ও দেশটির সাবেক সিনেটর আফরাসিয়াব খাত্তাক জানান, তিনি সিনেটর থাকা অবস্থায় গুম হয়ে যাওয়ার এসকল ঘটনার তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছেন৷ কমিটির তদন্তে দেখা গেছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা দপ্তর এসকল গুমের ঘটনার সাথে জড়িত৷
তিনি বলেন, ‘গোয়ন্দেদের আইনের আওতায় আনতে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি আইন প্রণয়ন করার কথা বলেছিলাম৷ বারবার বলার পরও তারা আমার অনুরোধে সাড়া দেয়নি৷’
তার অভিযোগ, গোয়েন্দা দপ্তরের সদস্যরা কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলতে চায় না৷
২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর পাকিস্তানে গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দেশটির বহু মানুষ শিকার হয় আত্মঘাতী বোমা হামলার।
মোশাররফের আমলেই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্মিলিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। বহু লোককে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক করে নিয়ে যায় সরকারি বাহিনীগুলো। আটককৃতদের অনেককেই তুলে দেয়া হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে।
বন্দি করে রাখা হয় কুখ্যাত গুয়ানতানামো কারাগারে। গুমের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন মানবাধিকার সংস্থা ডিফেন্স অব হিউম্যান রাইটস পাকিস্তানের চেয়ারম্যান ও খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী আমিনা মাসুদ জাঞ্জুয়া বলেন, গত দুই দশকে পাকিস্তানে ৫ হাজারের বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে।
অ্যামনেস্টির মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কমিশনের কাছে ৩ হাজার গুমের মামলা এসেছে। গুমের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই সিন্ধু ও বালোচিস্তানের।
তবে দেশটির বিচারবিভাগ বলছে, এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত। যারা এ ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সরকারের সেই বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ বা কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
ডন বলছে, কেবল ২০১৬ সালের প্রথম ৭ মাসেই ৫১০টি গুমের রিপোর্ট করেছে পত্রিকাটি।
যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান পলিটিক্সের অধ্যাপক আকিল শাহ বলেন, রাজনীতিবিরোধী নেতাদের গুম-অপহরণ সংস্কৃতি এ অঞ্চলের বহুল প্রচলিত ‘পুরাতন ঐতিহ্য। সম্প্রতি বছরগুলোতে এ অপচর্চা আরও বেড়েছে। আর এ জন্য দায়ী সরকার ও তার আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী। সরকারি স্বার্থবিরোধী সামাজিক মাধ্যম ও রাজনীতিক, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর সাঁড়াশি অভিযানের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১৪৮
আপনার মতামত জানানঃ