১৯৮৭ সাল। নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট ওয়েনের গুহাগুলির মানচিত্র নির্মাণ ও ভূপ্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য সেখানে পাড়ি জমিয়েছিলেন একদল স্পিলিওলজিস্ট। তবে গুহা আবিষ্কার করতে গিয়েই, তারা সন্ধান পান সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়ের।
গুহার মধ্যে উদ্ধার হয় প্রাচীন কোনো প্রাণীর আস্ত একটি নখরযুক্ত পা। যার আয়তন অন্ততপক্ষে এক ফুট। তুষারের মধ্যে জমাট বেঁধে থাকায় অক্ষত অবস্থায় অবশিষ্ট ছিল প্রাণীটির পেশী এবং ত্বকের কলাও। তবে কি অজানা কোনো শিকারি প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে নিউজিল্যান্ডের এই অঞ্চলে?
গবেষকদের একাংশের অভিমত ছিল, এই পা আসলে ডাইনোসরের। কারোর মুখে শোনা গিয়েছিল ‘শয়তান-তত্ত্ব’-ও। তবে এই রহস্যের সমাধান মেলে আরও বছর কয়েক করে। নিউজিল্যান্ডের গুহা থেকে প্রাপ্ত নখরের জিনগত বিশ্লেষণে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। না, কোনো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী নয়। এই বিশেষ প্রাণীটির বয়স মাত্র ৩৩০০ বছর। এবং, সেটি আদতে একটি পাখি।
নিউজিল্যান্ডের প্রাণীবিদরা এই বিশেষ পাখিটিকে চিহ্নিত করেন ‘মোয়া’ (Moa) নামে। গবেষণায় উঠে আসে, প্রাচীন গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের সময় থেকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৮ কোটি বছর আগে থেকেই পৃথিবীতে বসবাস এই বিশেষ পাখিটির। অর্থাৎ এককথায় তাকে জীবিত জীবাশ্ম বললেও ভুল হয় না এতটুকু।
পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ধার হয় এই প্রাচীন পক্ষী প্রজাতির আরও বেশ কিছু দেহাবশেষ। সেখান থেকেই জানা যায়, আনুমানিক চতুর্দশ শতক পর্যন্তও পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করতে মোয়ারা। মোট ৯টি প্রজাতি ছিল তাদের।
যার মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রজাতি ‘রোবাস্টাস’-এর গড় উচ্চতা ছিল প্রায় ১২ ফুট, ওজন আড়াইশো কেজির-ও বেশি। উটপাখি, কিউয়ি বা এমুর মতোই উড়তে পারত না মোয়াও। তবে আজকের দৌড়বাজ পাখিদের সঙ্গে পার্থক্য হল, ডানা ছিল না অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই পাখিটির। কিন্তু কীভাবে হারিয়ে গেল আধুনিক বিশ্বের সর্ববৃহৎ দৌড়বাজ পক্ষীটি?
গবেষণা বলছে, আজ থেকে ৭ কোটি বছর আগে আন্টার্কটিকা মহাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দ্বীপরাস্ট্র নিউজিল্যান্ড, এই দ্বীপে ছিল না কোন শিকারী প্রানী। ফলে ভাল ভাবেই ৮ লক্ষ বছরের ও বেশী সময় ধরে রাজত্ব করে চলেছিল মোয়া পাখি।
ধারনা করা হয় যে নির্বিচার শিকার এবং বনজঙ্গল উজাড় হওয়ার কারনে বিলুপ্ত হয়ে যায় মোয়া পাখি। এরা উড়তে পারত না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উচ্চতা হত ১২ ফুট পর্যন্ত এবং ওজন থাকত ২৫০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। এরা ছিল তৃনভোজী। প্রায় ১১ প্রজাতির মোয়া পাখি পাওয়া যেত । এদের মধ্যে সবচে’ বড় প্রজাতি ছিল ডাইনরনিস ম্যাক্সিমাস (Dinornis maximus)।
১০ম শতাব্দীতে প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপ থেকে মাওড়িরা বসতি স্থাপন শুরু করে। সুশ্বাদু মাংশের সহজলভ্য উৎস হিসেবে পেয়ে যায় মোয়া পাখিদের। নির্বিচারে চলল পাখি নিধন। ফলে ১৪০০ সালের দিকে অর্থাৎ এই দ্বীপে ইউরোপীয়দের পা পড়ার আগেই মোয়া পাখি শুন্য হয়ে যায় নিউজিল্যান্ড।
গবেষণা বলছে, ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে নিউজিল্যান্ডে বসবাস শুরু করেন মাওরি ও অন্যান্য পলিনেশিয় জনগোষ্ঠীগুলি। তারপরেই নির্বিচারে শিকার শুরু হয় মোয়াদের। দেখতে দেখতে মাত্র কয়েকশো বছরের মধ্যেই অবলুপ্ত হয়ে যায় তারা। এর দু শতকের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যায় মোয়াদের একমাত্র খাদক হাস্ট ঈগলও।
বর্তমানে ১৭০-এরও বেশি পাখি প্রজাতির আবাসস্থল নিউজিল্যান্ড। যার মধ্যে ৮০ শতাংশই স্থানীয় প্রজাতি। অর্থাৎ, বিশ্বের আর কোথাও অস্তিত্ব নেই তাদের। মোয়ারাও ছিল তেমনই একটি প্রজাতি। নিউজিল্যান্ডের বাইরে এখনও পর্যন্ত অন্য কোনো দেশে পাওয়া যায়নি এই প্রাচীন পক্ষী-প্রজাতির অস্তিত্ব।
শুধু আজ নয়, আদি কাল থেকেই মানব সভ্যতার সঙ্গে সংঘাতে যে বিপন্ন হয়েছে বন্যপ্রাণীরা, তারই জীবন্ত উদাহরণ মোয়া।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ