বাংলাদেশ পুলিশ মূলত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে গুলি চালানোয়, মানুষ হত্যায়, নির্যাতন করতে, দুর্নীতিতে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত, মাত্র এই তিন বছরে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হন ৫৯১ জন। ছয় ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এসব ঘটনা সর্বাধিক ঘটিয়েছে পুলিশ ও ডিবি পুলিশ। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে র্যাব। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশের গুলিতেও নিহত হয়েছেন মানুষ। ৮টি জেলা বাদে গোটা বাংলাদেশেই সরকারি ভাষ্যমতে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে।
এর মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ৫১২, ক্রসফায়ার ৪, গোলাগুলি ১৫, হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ১৫, গুলি করে হত্যা ৩৪ এবং নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। গুলি ছোড়া হলে প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছে বোঝাতে বন্দুকযুদ্ধ শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী ৮৬ শতাংশ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যুর ১৭টি ঘটনা ঘটলেও গুলি করে হত্যা, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ২০০৫, ২০১৩ ও ২০১৮ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ে। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় এই সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
বড় ফ্রেমে রাখলে সংখ্যাটা আরও ভয়ঙ্কর। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৪ জন মানুষ। পৃথিবীতে দুই ধরনের খুন অবৈধ নয়। প্রথমটি হচ্ছে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। দ্বিতীয় বৈধ খুন হচ্ছে আত্মরক্ষার্থে কাউকে মেরে ফেলা। কিন্তু এর বহু শর্ত আছে বিভিন্ন দেশের ফৌজদারি আইনে।
আমাদের দেশের পেনাল কোডেও আত্মরক্ষার্থে খুনের কঠোর শর্ত রয়েছে। যেমন আমি এটি করতে পারব শুধু তখনই, যখন কেউ আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয় এবং এটি প্রতিরোধে তাকে খুন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় না থাকে। আত্মরক্ষায় নরহত্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে সমানুপাতিক শক্তিপ্রয়োগের শর্ত। আমাকে একজন লাঠি দিয়ে মারতে এল, আমি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাকে মাথায় গুলি করতে পারি না। আমি প্রথমে তাকে অস্ত্র দেখিয়ে সতর্ক করব, ফাঁকা গুলি করব, তারপর প্রয়োজন হলে তার পায়ে গুলি করব। এসব শর্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাউকে মেরে ফেললে খুনের অভিযোগে এমনকি আমারই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে এসব শর্ত আরও কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। আইনে আত্মরক্ষার অধিকারের মধ্যে অন্যকে রক্ষার অধিকারও রয়েছে। এই ব্যাখ্যা বলে পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু আত্মরক্ষার্থে নয়, অন্যের জীবন ও সম্পদ এবং রাষ্ট্রীয় স্থাপনা রক্ষার জন্যও প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করা।
তবে এই শক্তি প্রয়োগ সব সময় আইনসংগতভাবে হয় কি না, এ নিয়ে সমাজে প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রশ্ন আরও গুরুতর করেছে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির মিছিলে পুলিশের গুলি। বর্বরোচিত এই ঘটনা সরকারের দমনমূলক ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বহিঃপ্রকাশ। বিএনপির নেতা কর্মীদের উপর পুলিশের হামলা-আক্রমণ ও নির্বিচার গুলি বর্ষণে নেতা কর্মী হতাহতের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে সমস্ত সচেতন মহল।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দমন-পিড়ন চালিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যেয়ে সরকার ও সরকারি দল সন্ত্রাসী পথ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে বিরোধীদের কন্ঠরোধ করতে যেয়ে গোটা দেশে তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। রাজপথ দখলে রাখতে যেয়ে তারা প্রতিশোধাত্মক রাজনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে। বিরোধীদের দমন করতে গিয়ে দেশকে তারা গভীর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে নিহতদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করে তিনি এই ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার আহবান জানান।
কী ঘটেছিল সেদিন? সূত্র মতে, বিএনপির ৪৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঘটনার দিন নারায়ণগঞ্জে শোভাযাত্রা বের হয়। সেই শোভাযাত্রায় পুলিশ বাধা দেওয়ায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। নারায়ণগঞ্জের ২নং রেলগেটের কাছে এদিন সকাল ১০ টায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। তাদের শোভাযাত্রায় পুলিশ বাধা দিলে, পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট, পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। পুলিশও পাল্টা বিক্ষোভকারীদের গুলি, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ছুঁড়তে শুরু করে। এতে নিহত হয়েছে বিএনপি কর্মী শাওন (২০)।
পুলিশের গুলিতে নিহত শাওন বিএনপির যুব দলের সদস্য ছিল। তার বাবা শাহেদ আলীও বিএনপির সক্রিয় সদস্য বলে জানা গেছে। পুলিশের এহেন কান্ডে দিকে দিকে বিক্ষোভ শুরু করেছে বিএনপি কর্মী-সমর্থকরা।
তবে পুলিশের এই হত্যাকাণ্ড কী শাস্তিযোগ্য নয়? আইন কী বলছে? মূলত বাংলাদেশের আইন পুলিশের শক্তি প্রয়োগ সমর্থন করে শর্ত সাপেক্ষে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৮ ধারায় পুলিশকে শক্তি প্রয়োগ করে জননিরাপত্তার জন্য হুমকিমূলক সমাবেশ বা বেআইনি সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৩০(২) ধারায় এ কাজ করতে গিয়ে যতটা সম্ভব কম শক্তি প্রয়োগ ও যতটা সম্ভব জনতার কম ক্ষতি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলে (পিআরবি, ১৫৪-১৫৮ ধারা) পুলিশকে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আত্মরক্ষা, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার কার্যকর করা—এই তিন ক্ষেত্রে। আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী সমাবেশ মোকাবিলায় এক্সট্রিম মেজার (চরমপন্থা) হিসেবে গুলি করার অনুমোদন রয়েছে, তবে এটি করা যাবে কেবল অন্য কোনোভাবে এমন সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা অসম্ভব হয়ে উঠলে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হলে তা নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্টভাবে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, পরিহারযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি না করার কথা বলা আছে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার যৌক্তিক ছিল কি না, সে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ নির্বাহী তদন্ত করার কথাও পিআরবিতে বলা আছে।
ঔপনিবেশিক আমলে করা এসব আইনের (পেনাল কোড, সিআরপিসি, পিআরবি) তুলনায় এ–সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন ও প্র্যাকটিস আরও কঠোর। ১৯৯০ সালের জাতিসংঘ আইন প্রয়োগাকারী সংস্থা কর্তৃক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কিত ২৬টি মূল নীতিমালা গ্রহণ করেছে।
সেখানে বলা আছে, মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের অত্যাসন্ন হুমকি ছাড়া শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না, একেবারে অপরিহারযোগ্য (স্ট্রিক্টলি আনঅ্যাভয়েডেবল) ক্ষেত্রে অস্ত্র ব্যবহার করতে হলে মানুষের জীবনের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, যতটা সম্ভব কম ও আনুপাতিক শক্তি ব্যবহার করতে হবে, অস্ত্র ব্যবহারের আগে যথেষ্ট পরিমাণে ওয়ার্নিং দিতে হবে এবং প্রথমে বিক্ষোভকারীদের জীবন রক্ষার্থে নন-লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করতে হবে।
এতে সরকারকে অস্ত্র ব্যবহার সম্পর্কিত বিস্তারিত গাইডলাইন প্রণয়ন, আহত ব্যক্তিদের দ্রুত ও উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শক্তি প্রয়োগের শিকার মানুষের প্রতিকার পাওয়ার আইনগত অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়।
উন্নত বিশ্বে শক্তি প্রয়োগ সীমাবদ্ধ করার জন্য পুলিশের বড় একটি অংশকে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদানই করা হয় না, উন্মত্ত সমাবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় লেস লেথাল বা নন-লেথাল (যেমন পেপার স্প্রে, অচেতন করার অস্ত্র, রাবার বুলেট এবং প্রবল ধোঁয়া ও শব্দ উৎপাদনকারী স্পঞ্জ গ্রেনেড) সরঞ্জাম দিয়ে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩৩
আপনার মতামত জানানঃ