বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ভারতে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ যুবক। সেই বেকারদের একাংশ হতাশ হয়ে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। বেকারত্ব ছাড়াও নানা কারণেই ভারতে বাড়ছে আত্মহত্যা। উদ্বেগের বিষয় হলো দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছেই।
ভারতে গত এক বছরে (২০২১) এক লাখ ৬৪ হাজার ৩৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে দেশটির মহারাষ্ট্রে। এরপরই রয়েছে তামিলনাড়ু ও মধ্যপ্রদেশে। এই তালিকার চতুর্থ স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে।
মূলত কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, নিঃসঙ্গতা, অত্যাচার, পারিবারিক সমস্যা, মারপিট, মদ্যপান, আর্থিক ক্ষতির কারণেই ভারতের অধিকাংশ মানুষ আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেন বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। ২০২১ সালে তার আগের বছরের তুলনায় দেশটিতে প্রায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে।
গতবছরে মহারাষ্ট্রে ২২ হাজার ২০৭ জন, তামিলনাড়ুতে ১৮ হাজার ৯২৫, মধ্যপ্রদেশে ১৪ হাজার ৯৬৫, পশ্চিমবঙ্গে ১৩ হাজার ৫০০ ও কর্ণাটকে ১৩ হাজার ৫৬টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দেশের ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ আত্মহত্যা হয়েছে এই পাঁচ রাজ্যে।
তবে ভারতের সবচেয়ে বেশি জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেকটাই কম। মোট আত্মহত্যার মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে যোগীর রাজ্যে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মতে, ভারতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ১২ জন আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যার এই ঘটনা ভারতে মানুষের বেঁচে থাকার গভীর অনিচ্ছার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। অতিমারির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলেই আশঙ্কা।
২০২০ সালে মার্চে করোনার হানার পর থেকেই ভারতে কাজের বাজার বিপর্যস্ত। দীর্ঘ লকডাউনের ধাক্কায় ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা ধীরে ধীরে নামতে থাকে।
কিন্তু মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে সে পরিস্থিতি বদলে যায়। সংক্রমণ রোধ করতে রাজ্যগুলো স্থানীয় লকডাউন এবং বিধিনিষেধের পথে হাঁটায় আবারও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। বাড়তে বাড়তে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে বেকারত্বের হার দুই অঙ্ক পেরিয়ে যায়। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় তা আবারও কমতে থাকে। সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি আসা এবং বর্ষা মৌসুমের ওপর নির্ভর করেই বদলে যায় কাজের বাজারের অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় গত বছর লকডাউনের আগে থেকেই বেকারত্ব বাড়ছিল। ফলে করোনা মোকাবিলায় পুরো দেশ ঘরবন্দি হতেই বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে বেকারত্বের হার কমতে শুরু করে বটে, কিন্তু কর্মসংস্থানের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়েই ছিল। কাজকর্ম শুরু হলেও নিয়োগে ধারাবাহিক উন্নতি তেমন একটা চোখে পড়েনি।
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা না দিলে এবং প্রতিষেধক প্রয়োগের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে শুরুতেই শক্ত হাতে থামানো গেলে ভয় কাটত বলে মনে করছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, উৎপাদন এবং পরিষেবা বৃদ্ধির হাত ধরে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো নিশ্চিত হলে নিয়োগও বাড়ত। কিন্তু সিএমআইই তথ্য বলছে, এপ্রিলে তা তো হয়নি, বরং কর্মী আরও কমেছে। এমনকি কাজ খুঁজতেও বেরিয়েছেন অনেক কম মানুষ।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আত্মহত্যার এই ঘটনা ভারতে মানুষের বেঁচে থাকার গভীর অনিচ্ছার ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।
তাদের মতে, ‘এটা বেশিরভাগ ভারতীয়দের জন্য বড় ধাক্কা। সমৃদ্ধ পশ্চিমাঞ্চলে মুম্বাইয়ের মতো বড় শহর ও বন্দর রয়েছে। পাশেই রয়েছে ভারতের বাণিজ্য কেন্দ্র গুজরাট রাজ্য। সেখানে বড় বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হয়। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে হাজার হাজার মানুষ সেখানে চলে যায়। তারপরও যদি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলেই অনেক ভয়াবহ।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৪৬
আপনার মতামত জানানঃ